গোলটেবিল বৈঠক
নিউমোনিয়া রোধে চাই সচেতনতা
বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস উপলক্ষে সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ ও প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিলে চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞরা এ কথা বলেন।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধ ও চিকিৎসাযোগ্য। তাই শিশুর নিউমোনিয়া প্রতিরোধে কী করতে হবে এবং আক্রান্ত শিশুকে কীভাবে রোগের ভয়াবহতা থেকে বাঁচানো সম্ভব, তা জানতে হবে অভিভাবক ও কমিউনিটির লোকজনকে। নিউমোনিয়া নিয়ে ব্যাপক হারে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে বহু শিশুর প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। পাশাপাশি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর যথাযথ চিকিৎসায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ বাড়াতে হবে।
গতকাল মঙ্গলবার বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস উপলক্ষে সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ ও প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন।
‘প্রতিটি শ্বাস বাঁচায় জীবন: নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সক্রিয় হোন’ শিরোনামে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিউমোনিয়া থেকে সুরক্ষার জন্য জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে শুধু বুকের দুধ পান করাতে হবে। ছয় মাস পর থেকে আয়রনসমৃদ্ধ সম্পূরক খাবার খাওয়াতে হবে। নিউমোনিয়া প্রতিরোধে শিশুকে হাত ধোয়ানো ও নিরাপদ পানি পান করার অভ্যাস করতে হবে। শিশুকে গৃহস্থালি বায়ুদূষণ (রান্নাঘরের ধোঁয়া) ও বাইরের যেকোনো ধরনের বায়ুদূষণ থেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। শিশুকে ভিটামিন এ খাওয়ানোর পাশাপাশি নিউমোনিয়া প্রতিরোধসহ সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) আওতাভুক্ত টিকাগুলো দিতে হবে। আর শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে কিছু বিপদ–চিহ্নের প্রতি সচেতন হতে হবে অভিভাবকদের। যেমন জ্বর, শিশু দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে কি না, শিশুর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কি না, শ্বাস নেওয়ার সময় বুক দেবে যাচ্ছে কি না।
বৈঠকে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বিশ্বে প্রতিবছর পাঁচ বছরের কম বয়সী যত শিশু রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, তার মধ্যে নিউমোনিয়ায় মৃত্যু সবচেয়ে বেশি। বছরে ১০ লাখ মৃত্যুর মধ্যে সাড়ে ৭ লাখই ঘটে নিউমোনিয়ায়। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুই হাজার শিশুর প্রাণ যাচ্ছে নিউমোনিয়ায়। সেই সব শিশুই মারা যাচ্ছে, যারা টিকা, অক্সিজেন ও অ্যান্টিবায়োটিকের মতো জরুরি চিকিৎসা পাচ্ছে না। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫ বছরের কম বয়সী ২৬ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। ৫ বছরের কম বয়সী মোট শিশুমৃত্যুর ২৪ শতাংশ হচ্ছে নিউমোনিয়ায়। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে জীবিত জন্ম নেওয়া প্রতি হাজার শিশুর মধ্যে ৭ দশমিক ৪টি শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ২০১৭-১৮ প্রতিবেদনে তা ছিল প্রতি হাজারে ৮ শিশু। বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে নিউমোনিয়ায় মৃত্যু প্রতি হাজারে ৩ জনে নামিয়ে আনতে হবে।
গোলটেবিল বৈঠকে শিশুস্বাস্থ্য–বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নাজমুন নাহার বলেন, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে হাসপাতালে দেরিতে আসার কারণে অনেকে মারা যায়। তাই নিউমোনিয়ার শুরুতে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে ব্যাপক হারে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। চিকিৎসাসেবা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছাকাছি নিতে হবে এবং সুলভ করতে হবে। নিউমোনিয়া চিকিৎসায় পদক্ষেপ বাড়াতে বেসরকারি চিকিৎসা খাতকেও সম্পৃক্ত করতে হবে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচির প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. জহুরুল ইসলাম। তিনি জানান, নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যু কমানোর ক্ষেত্রে দেশ এখনো লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে রয়েছে। নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে সুরক্ষা, প্রতিরোধ এবং আক্রান্ত হলে কী করতে হবে, তা যথাযথ অনুসরণ হলে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। এখন শিশুর ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ পান করানোর হার কমে গেছে। বায়ুদূষণের ভয়াবহতা ও নিরাপদ পানির ঘাটতি যেমন রয়েছে, তেমনি চিকিৎসার জন্য জনবল, বিরামহীন মেডিকেল অক্সিজেন সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। অ্যামোক্সিসিলিন ট্যাবলেটের উৎপাদন ও সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। এ বিষয়গুলোতে নজর বাড়িয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে শক্তিশালী করতে হবে।
বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের (বিসিপিএস) সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, নিউমোনিয়ার বিপদ–চিহ্নগুলো সম্পর্কে জানাতে প্রচার বাড়াতে হবে। শিশুর শ্বাস গুনতে হবে। শিশুর শ্বাসের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। শ্বাস নেওয়ার সময় বুকের খাঁচা দেবে যাচ্ছে কি না দেখতে হবে।
বারডেমের মা ও শিশু হাসপাতালের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, গ্রামে হাসপাতালের বাইরে বিভিন্ন ওষুধের দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। অনিয়ন্ত্রিতভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের কারণে দেহ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। এ বিষয়গুলোতে নজর দেওয়া দরকার।
নিউমোনিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেল অক্সিজেন দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা দরকার বলে মন্তব্য করেন আইসিডিডিআরবির মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী বিজ্ঞানী শফিকুল আমীন। তিনি বলেন, পালস অক্সিমিটারে শিশুর অক্সিজেন স্যাচুরেশন কম এলে ওই শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে যার অক্সিজেন প্রয়োজন, তাকেই শুধু দেওয়া দরকার।
সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের উপদেষ্টা গৌতম বণিক বলেন, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে হাসপাতালে আনার ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়াতে সেভ দ্য চিলড্রেন বিভিন্ন জায়গায় তরুণদের সম্পৃক্ত করেছে। প্রান্তিক জনপদে কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা দানকারীরা যেন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রথম ডোজ দেন, সেই বিষয়েও প্রচার বাড়াতে বলেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচির উপপ্রকল্প ব্যবস্থাপক সাবিনা আশরাফী লিপি জানান, সরকার নিউমোনিয়াকে আলোকপাত করে নতুন কার্যক্রম নিয়েছে।
বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপক দেওয়ান মো. ইমদাদুল হক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের কর্মসূচি কর্মকর্তা মো. নূরুল ইসলাম খান এবং প্রজন্ম রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (পিআরএফ) উপপরিচালক সাব্বীর আহমেদ। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।