মানব চরিত্রের উৎকর্ষ সাধনই ইসলামের মূল লক্ষ্য। এ মহান লক্ষ্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আদি যুগ থেকে নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (স.)-কে পাঠিয়েছেন মানবতার উৎকর্ষের পূর্ণতা দিতে।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘আমাকে পাঠানো হয়েছে সুন্দর চরিত্রের পূর্ণতা প্রদানের জন্য।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা কোরআন কারিমে বলেন, ‘হে মুহাম্মদ! (সা.) নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সুরা-৬৮ কলম, আয়াত: ৪)।
চরিত্রের উত্তম গুণাবলির অন্যতম হলো ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা। পবিত্র কোরআনে স্থানে স্থানে মহান আল্লাহ নিজেকে ধৈর্যশীল ও পরম সহিষ্ণু হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। ধৈর্যের আরবি হলো ‘সবর’। সহিষ্ণুতার আরবি হলো ‘হিলম’। ‘সবর’ ও ‘হিলম’ শব্দ দুটির মাঝে কিঞ্চিৎ পার্থক্য রয়েছে। হিলম অর্থাৎ সহিষ্ণুতার মানে হলো শক্তি-সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ গ্রহণ না করা। এ অর্থে হিলম সবর অপেক্ষা উন্নততর। এ উভয় শব্দ কখনো কখনো অভিন্ন অর্থে তথা উভয় অর্থে ও একে অন্যের স্থানে ব্যবহৃত হয়। হিলম তথা সহিষ্ণুতা সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল-কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ তো সম্যক প্রজ্ঞাময়, পরম সহনশীল।’ (সুরা-২২ হজ, আয়াত: ৫৯)। সবর অর্থাৎ ধৈর্য সম্পর্কে কোরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি তো তাকে পেলাম ধৈর্যশীল। কত উত্তম বান্দা সে! সে ছিল আমার অভিমুখী।’ (সুরা-৩৮ ছদ, আয়াত: ৪৪)। ‘নিশ্চয় ইহাতে তো নিদর্শন রয়েছে প্রত্যেক পরম ধৈর্যশীল ও পরম কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য।’ (সুরা-১৪ ইব্রাহিম, আয়াত: ৫)।
ধৈর্যের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআন মাজিদে বলেছেন, ‘মহাকালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয় যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ (সুরা-১০৩ আসর, আয়াত: ১-৩)। এই সুরার শেষে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ধৈর্যকে সাফল্যের নিয়ামক রূপে বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করো এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকো, আল্লাহকে ভয় করো যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ (সুরা-৩ আল ইমরান, আয়াত: ২০০)।
ধৈর্য ধারণকারীর সাফল্য সুনিশ্চিত কারণ আল্লাহ তাআলা ধৈর্য ধারণকারীর সঙ্গে থাকেন; আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যাঁর সঙ্গে থাকবেন তাঁর সফলতা অবধারিত। কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সহিত আছেন।’ (সুরা: ২ বাকারা, আয়াত: ১৫৩)।
ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক হজরত আইয়ব (আ.) ১৮ বছর পর্যন্ত সহিষ্ণুতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে পরম সাফল্য লাভ করেছিলেন। নবী হজরত ইউনুস (আ.)-কে সামান্য অধৈর্য হওয়ার কারণে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাতের আঁধারে উত্তাল সমুদ্রবক্ষের মৎস্য উদরে যেতে হয়েছিল। এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উদ্দেশে কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ করো তোমার প্রতিপালকের নির্দেশের অপেক্ষায়, তুমি মৎস্য-সহচর (ইউনুস আ.)-এর ন্যায় অধৈর্য হয়ো না, সে বিষাদগ্রস্ত অবস্থায় কাতর প্রার্থনা করেছিল।’ (সুরা-৬৮ কলম, আয়াত: ৪৮)।
ধৈর্য তিন প্রকার। যথা: ‘সবর আনিল মাসিয়াত’ অর্থাৎ অন্যায় অপরাধ থেকে বিরত থাকা। ‘সবর আলাত তআত’ অর্থাৎ ইবাদত আল্লাহর আনুগত্য ও সৎকর্মে কষ্ট স্বীকার করা। ‘সবর আলাল মুসিবাত’ অর্থাৎ বিপদে অধীর না হওয়া। (তাফসিরে বায়জাবি)।
কোনো ব্যক্তি যদি উপরিউক্ত অর্থে ধৈর্য অবলম্বন করেন; তবে তাঁর জীবনে পূর্ণতা ও সফলতা অনস্বীকার্য। কারণ, প্রথমত অন্যায় অপরাধ তথা পাপকার্য থেকে বিরত থাকা সকল প্রকার অকল্যাণ ও গ্লানি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়। দ্বিতীয়ত: ইবাদত ও সৎকর্ম সম্পাদন করা সফলতার একমাত্র সোপান। তৃতীয়ত: প্রতিকূলতায় দৃঢ়পদ থাকা লক্ষ্যে পৌঁছার একমাত্র মাধ্যম। সুতরাং ‘সবর কামিল’ বা পরিপূর্ণ ধৈর্য এবং ‘সবর জামিল’ বা উত্তম ধৈর্যই মানবজীবনকে পূর্ণতা দিতে পারে। আমাদের উচিত সকল অনভিপ্রেত অবস্থায়, যেকোনো অযাচিত পরিবেশ ও অনাহুত পরিস্থিতিতে নিজেকে সংযত রেখে দৃঢ়তার সঙ্গে লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাওয়া। তবেই আল্লাহর সাহায্য আমাদের সাথি হবে, আল্লাহ আমাদের সঙ্গী হবেন।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail, com