বঙ্গীয় খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধ ও বড়দিনের ঐতিহ্য

ভারতের চেন্নাইয়ের সেন্ট অ্যান্টনি গির্জায় শিশু যিশুর মূর্তিতে শিশুর চুম্বনছবি: এএফপি

বাংলায় খ্রিষ্টধর্মের প্রচার শুরু হয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীতে, যখন পর্তুগিজ সমুদ্রযাত্রীরা এ অঞ্চলে আগমন করেন। তাঁদের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো বাংলায় খ্রিষ্টধর্মের প্রচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়।

১৫৭৭ সালে মোগল সম্রাট আকবর পর্তুগিজদের তৎকালীন বঙ্গদেশে স্থায়ী বসতি স্থাপন ও গির্জা নির্মাণের অনুমতি দেন।

পর্তুগিজ বসবাসকারীরাই বাংলার প্রথম খ্রিষ্টান এবং দেশীয় খ্রিষ্টানরা তাঁদের বংশধর। পরবর্তী সময়ে, মিশনারিদের প্রচেষ্টায় খ্রিষ্টধর্মের বিস্তার ঘটে এবং খ্রিষ্টান জনগণের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

বিশ্বজুড়ে বড়দিন বা ক্রিসমাস যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন হিসেবে ২৫ ডিসেম্বর উদ্যাপিত হয়। যিশুখ্রিষ্টের জন্মের পর পবিত্র নগরী জেরুজালেম মন্দিরে তৎকালীন ধর্মীয় রীতি অনুসারে তাঁর উৎসর্গের দিন থেকেই খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডার প্রচালন শুরু হয়।

তা ছাড়া আদিযুগীয় খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস অনুসারে, এই তারিখের ঠিক ৯ মাস আগে কুমারী মেরির গর্ভে প্রবেশ করেন যিশুখ্রিষ্ট।

আর এই হিসাব অনুসারেই ২৫ ডিসেম্বর তারিখটিকে যিশুর জন্মতারিখ ধরে বিশ্বব্যাপী পবিত্রভাবে বড়দিন উৎসব উদ্যাপন করা হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন

বাংলায় খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে বড়দিন উদ্যাপনও শুরু হয়। পর্তুগিজদের আগমনের পর থেকেই তাঁরা তাঁদের ধর্মীয় উৎসবগুলো, বিশেষ করে বড়দিন উদ্যাপন করতে থাকেন।

এভাবে বাংলায় বড়দিন উদ্যাপনের ঐতিহ্য গড়ে ওঠে, যা পরবর্তী সময়ে স্থানীয় খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যেও প্রচলিত হয়, এবং এটি খ্রিষ্টধর্মের মূল মূল্যবোধের প্রতীক।

বড়দিনের মূল বার্তা হলো প্রেম, শান্তি এবং মানবতার সেবা। যিশুখ্রিষ্টের জন্ম মানবজাতির জন্য ঈশ্বরের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রকাশ।

তাঁর শিক্ষা অনুযায়ী, মানুষকে একে অপরকে ভালোবাসতে, ক্ষমা করতে এবং দুস্থদের সহায়তা করতে উৎসাহিত করা হয়। বাঙালি খ্রিষ্টানরা এই মূল্যবোধকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করেন।

বাঙালি খ্রিষ্টান সম্প্রদায় বড়দিন উদ্যাপনে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে। এই দিনে গির্জায় বিশেষ প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে যিশুর জন্মের কাহিনি পবিত্র শাস্ত্র তথা বাইবেল থেকে পাঠ করা হয় এবং তাঁর শিক্ষার ওপর আলোচনা করা হয়।

পরিবারের সদস্যরা একত্র হয়ে প্রার্থনা করেন এবং বিশেষ খাবারের আয়োজন করেন। বড়দিনের কেক, পিঠাপুলি এবং অন্যান্য বাঙালি খাবার এই উৎসবের আনন্দ বাড়িয়ে তোলে।

আরও পড়ুন

বড়দিন কেবল খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।

বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এই উৎসবে অংশগ্রহণ করেন, যা সামাজিক সংহতি ও সম্প্রীতির প্রতীক।

বড়দিনের সময় বিভিন্ন সামাজিক ও দাতব্য কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়, যেখানে দুস্থ ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রচলন রয়েছে।

বাঙালি খ্রিষ্টানদের বড়দিন উদ্যাপনে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশ্রণ দেখা যায়। গির্জার প্রার্থনা, নগরকীর্তন/ক্যারোল গান এবং নৃত্য-গীতের পাশাপাশি ক্রিসমাস ট্রি সাজানো, আলপনা অঙ্কন, উপহার বিনিময়, এবং আলোকসজ্জার মাধ্যমে উৎসবের আনন্দ উদ্যাপন করা হয়।

এভাবে বাঙালি খ্রিষ্টানরা তাঁদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে বড়দিন উদ্যাপন করেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বাংলাদেশের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও বড়দিন উদ্যাপনে অংশগ্রহণ করছেন। বড়দিনের সময় টেলিভিশন ও রেডিওতে বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়, যা উৎসবের আমেজকে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়।

প্রিন্ট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বড়দিনের বিশেষ আয়োজন থাকে, যার মাধ্যমে খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে সবাইকে অবগত হওয়ার সুযোগ পায়।

এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বড়দিন উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, যা দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ।

থিম পার্ক, চিড়িয়াখানা এবং জাদুঘর পরিদর্শন, রেস্তোরাঁয় ভোজ এবং বাড়িতে ছোট পরিসরে বড়দিনের পার্টি আয়োজনের মাধ্যমে সবাইকে এই উৎসবে শামিল হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

বড়দিন বাঙালি খ্রিষ্টানদের জীবনে আধ্যাত্মিকতা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক সংহতির প্রতীক হিসেবে বিশেষ স্থান অধিকার করে।

এই উৎসবের মাধ্যমে তাঁরা যিশুখ্রিষ্টের শিক্ষাকে জীবনে প্রতিফলিত করার পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখেন।

সাধু লুক তাঁর পবিত্র সুসমাচারে যিশুখ্রিষ্টের জন্মের বর্ণনায় বলেছেন, ‘ঊর্ধ্বলোকে ঈশ্বরের মহিমা, পৃথিবীতে তাঁহার প্রীতিপাত্র মনুষ্যদের মধ্যে শান্তি।’

বড়দিনের এই ঐতিহ্য বাঙালি খ্রিষ্টানদের জীবনে খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটায় এবং সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেয়।

প্যারাসেলসাস জয় সিংহ, ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (কোয়ালিটি অ্যান্ড টেকনিক্যাল), ইন্টারস্টফ গ্রুপ