মহানবী (সা.) কি ‘প্রথম সৃষ্টি’
মহানবী (সা.) সৃষ্টি জগতের প্রথম সৃষ্টি, এই কথাটি প্রবাদের মতোই মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি এ নিয়ে বহু কাব্য ও গান রচিত হয়েছে। কত গাঁথা-গল্প ও বয়ান-আজকার যে আছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এমনকি বহু যুক্তিও তুলে ধরেন ওয়ায়েজ তার মাহফিলে। শ্রোতারা শুনে কাঁদেন এবং হাসেন। এইসব গল্প-গাঁথার সঙ্গে যদি আপনি দ্বিমত কখনো করেন, কিন্তু নবীজি(সা.) যে ‘প্রথম সৃষ্টি’ সেটা মানতে কখনও কারও প্রশ্ন জাগেনি। কেননা সবাই ভাবেন, এর মাধ্যমে তো নবীজিকে শ্রেষ্ঠত্বের জায়গাই দেওয়া হয়।
লক্ষ করলে দেখা যাবে, বিষয়টি শামায়েল ও খাসায়েস (চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য) গ্রন্থাবলিরও একটা স্থান দখল করে নিয়েছে।
আল্লামা সুয়ুতি (র.) এ-বিষয়ক অধ্যায়ের শিরোনাম লিখেছেন এভাবে, ‘সৃষ্টজীবের মধ্যে নবীজি (সা.)-এর সর্বপ্রথম সৃষ্টি হওয়া, নবুয়তপ্রপ্তিতে তার প্রাধান্য এবং তার ব্যাপারে অন্য নবীদের থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত অধ্যায়’। তারপর তিনি বলেছেন, ইবনে আবু হাতেম তার তাফসীর গ্রন্থে এবং আবু নুয়াইম তার দালায়েল গ্রন্থে হাসান ও কাতাদার সূত্রে আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে নবীজি (সা.) এ আয়াত (যখন আমি নবীদের থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছি—সূরা আহযাব, আয়াত ৭)-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, আমি সৃষ্টির ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম মানব আর নবী হওয়ার ক্ষেত্রে সর্বশেষ নবী। (আল-খাসায়েসুল কুবরা, তাহকিক ড. হুরাস, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৯)
আল্লামা কাসতালানি (র.)-এর বক্তব্যও অনুরূপ। তবে তিনি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলেছেন যে এটা প্রমাণ করে, মাটি থেকে আদমের আকৃতি তৈরি করার পর তার ভেতর থেকে নবীজি(সা.)কে বের করা হয়, নবুয়ত প্রদান করা হয় এবং তার থেকে প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়। এরপর আদম (আ.)-এর পৃষ্ঠদেশেই তাকে পুনস্থাপন করা হয়। এরপর সেই সময় প্রেরণ করা হয় তাকে, যে সময় তার জন্যে আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন। সুতরাং তিনি সৃষ্টিকুলের প্রথম। এই যুক্তি অবান্তর যে তাহলে আদম (আ.)-ই তো প্রথম সৃষ্টি হবে, কারণ আদম (আ.) তখন মৃত ছিলেন, তার দেহে প্রাণ ছিল না, আর নবীজি (সা.) ছিলেন তখন জীবিত; যখন তাকে বের করা হয়, নবুয়ত প্রদান করা হয় এবং তার থেকে প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়। সুতরাং তিনিই হবেন সৃষ্টির প্রথম আর আবির্ভাবে সর্বশেষ নবী। (আল-মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যাহ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৬২)
তাদের দু’জনের আগে আসবাহানি (র.) ‘দালায়েলুন নুবুওয়া’ গ্রন্থে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। (আসবাহানি কৃত দালায়েলুন নুবুওয়া, ভারতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১২)
নিরেট যাচাই-বাছাইয়ে বোঝা যায় ওপরের ব্যক্তিদের বর্ণিত হাদিসটি সহি নয়। কোনো বিশুদ্ধ বর্ণনাতেই নবীজি (সা.) কে প্রথম সৃষ্টি বলার কোনো প্রমাণ নেই। বরং কোরআনের আয়াতেই আল্লাহ–তায়ালা স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে, আদম (আ.)-কেই মানব জাতির মধ্যে প্রথম সৃষ্টি করা হয়েছে। এমনকি শয়তানের সৃষ্টি যে তারও আগে হয়েছে, সেই কাহিনীও বেশ ভালোভাবেই কোরআন বর্ণনা দিয়েছে। নবীজি (সা.) যদি প্রথম সৃষ্টি হতেন, তাহলে ইঙ্গিতে বা প্রচ্ছন্নভাবে হলেও কুরআনে তার স্থান পাওয়া বিচিত্র ছিল না। যেখানে কুরআন এ পর্যন্ত বলেছে যে, মুহাম্মাদ তোমাদের কারও পিতা নন।
প্রখ্যাত সিরাত-বিশেষজ্ঞ সালেহ আমদ শামী লিখেছেন, আশ্চর্যের বিষয় হলো, এসব বড় মাপের আলেম-ব্যক্তিত্ব কী করে হাদিসের বিশুদ্ধতা যাচাই না করেই সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলেন এবং এ-জাতীয় পর্যালোচনা পেশ করলেন? যদি তারা হদিসের শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাই করতেন, তাহলে তাদের পরিশ্রম সার্থক হতো এবং মুসলিম উম্মাহও সমৃদ্ধ হতো। (মিন মায়ীনিশ শামায়েল, অধ্যায় ১, পরিচ্ছেদ ১)
মিশরের প্রখ্যাত আলেম ও দায়ী ড. মুহাম্মদ খলিল হাসান হুরাস বলেন, তাদের বর্ণিত হাদিসটি আবু নুয়াইম তার দালায়েল গ্রন্থে এবং দাইলামি তার ফিরদাউস গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন বটে, কিন্তু এর সনদে ‘বাকিয়া’ নামক একজন বর্ণনাকারী আছেন, যিনি অভিযুক্ত এবং সাঈদ ইবনে বাশির নামক আরেকজন বর্ণনাকারী আছেন, যাকে ইবনে মাঈন প্রমুখ মুহাদ্দিস ‘দুর্বল রাবী’ আখ্যা দিয়েছেন। আল্লামা সাগানি ও ইবনে তাইমিয়াও হাদিসটিকে জাল বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। (আল-খাসায়েসুল কুবরা, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৯)
এ জাতীয় আরও কিছু হাদিস রয়েছে যা প্রত্যাখাত (মুনকার) ও বানোয়াট (জাল)। তবে রাসুল (সা.) যে নবী হবেন তা আদম (আ.) সৃষ্টিরও বহু আগে আল্লাহর ইলমে থাকাটা খুবই স্বাভাবিক, সেটা নিয়ে কোনো বিতর্কই নেই।