আমরা যে কোরআন পড়ি, সেটি তাঁরই সংকলন করা
হজরত উসমান ইবনে আফফান (রা.) ছিলেন ইসলামের তৃতীয় খলিফা। তিনি যথেষ্ট অর্থবান ছিলেন। খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি রাজকোষ থেকে কোনো বেতন নিতেন না। শাসনক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি কোরআন সংকলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আমরা যে কোরআন পড়ি, সেটি তাঁরই সংকলন করা। রাসুল (সা.)–এর মৃত্যুর পর কোরআনের প্রধান যে কপিটি তৈরি করা হয়, সেটি হাফসা (রা.)–এর কাছে ছিল।
হজরত উসমান (রা.) ছিলেন অত্যন্ত লাজুক। রাসুল (সা.) বলেছিলেন, ‘আমার উম্মতদের মধ্যে উসমান সবচেয়ে বেশি লজ্জাশীল।’
হজরত উসমান (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ কন্যা রুকাইয়াকে তাঁর সঙ্গে বিয়ে দেন। হিজরি দ্বিতীয় সনে মদিনায় রুকাইয়ার ইন্তেকাল হলে রাসুল (সা.) তাঁর আরেক কন্যা উম্মে কুলসুমকে তাঁর সঙ্গে বিয়ে দেন। এ কারণে উসমান (রা.) ‘যুননুরাইন’ বা ‘দুই জ্যোতির অধিকারী’ হিসেবে পরিচিতি পান।
কুরাইশদের প্রাচীন ইতিহাসে হজরত উসমান (রা.)–র ছিল গভীর জ্ঞান। অভিজাত কুরাইশদের মতো তিনিও ব্যবসা শুরু করেন। সততা ও বিশ্বস্ততার কারণে তাতে সাফল্যও পান। ধনী ব্যবসায়ী হিসেবে মক্কায় তিনি ‘গনি’ উপাধি লাভ করেন।
রাসুল (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখনো উসমান (রা.) মদিনায় হিজরত করেন। হাবশা ও মদিনা এ দুই জায়গায় হিজরত করে তিনি ‘খুল হিজরাতাইন’ বা দুই হিজরতের অধিকারী হন।
বদর যুদ্ধ ছাড়া সব যুদ্ধেই তিনি রাসুল (সা.)–এর সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন। বদর যুদ্ধের সময় তাঁর স্ত্রী রুকাইয়া খুব অসুস্থ ছিলেন। তাই রাসুল (সা.)–এর নির্দেশে স্ত্রীর সেবার জন্য তিনি মদিনায় থেকে যান। বদরের বিজয়ের খবর যে দিন মদিনায় এসে পৌঁছায়, সেদিনই হজরত রুকাইয়া ইন্তেকাল করেন।
হজরত উসমান (রা.) হজরত রাসুল (সা.)–এর সময়ে ওহি লেখক ছিলেন। হজরত আবু বকর (রা.) আর হজরত উমর (রা.)–র খিলাফতকালে ছিলেন পরামর্শদাতা। প্রতিবছরই তিনি হজ আদায় করতেন। শুধু যে বছর তিনি শহীদ হন, সে বছর ঘেরাও থাকার কারণে হজ আদায় করতে পারেননি।
তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতিকালে রাসুল (সা.) ইসলামি ফৌজের সংগঠন ও ব্যয় নির্বাহের জন্য সাহায্যের আবেদন জানালে তিনি এ যুদ্ধের এক-তৃতীয়াংশ সৈন্যের ব্যয়ভার নিজ কাঁধে তুলে নেন। তিনি ৯৫০টি উট ও ৫০টি ঘোড়া সরবরাহ করেন। ইবনে ইসহাক লিখেছেন, ‘তাবুকের বাহিনীর পেছনে হজরত উসমান (রা.) এত বিপুল অর্থ ব্যয় করেছেন যে আর কেউই তেমন ব্যয় করতে পারেনি।’
ইসলামের সংকটকালে আল্লাহর রাস্তায় তিনি যেভাবে খরচ করেছেন, তা চিরকাল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। মদিনায় আসার পর তিনি প্রচুর অর্থের বিনিময়ে ইহুদি মালিকানাধীন ‘বীরে রুমা’ কূপটি তাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে মদিনার মুসলিমদের জন্য ওয়াক্ফ করেন।
হজরত উসমান (রা.)–এর আমলে মুসলিম সাম্রাজ্য বিরাট বিস্তৃতি লাভ করে। উসমান (রা.) ক্ষমতা নেওয়ার পর জনগণের ভাতা আগের চেয়ে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছিলেন। উমর (রা.)–এর আমলে বিজিত অঞ্চলে জমি কেনাবেচা নিষিদ্ধ থাকলেও উসমান (রা.) এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং ব্যবসার সুযোগ বাড়িয়ে দেন। তাঁর আমলে ইসলামি বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুব সমৃদ্ধ।
তাঁর খিলাফতের শেষদিকে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠতে থাকে। বিদ্রোহীরা সংঘবদ্ধ হয়ে মদিনায় খলিফার বাসভবন ঘেরাও করে। খলিফাকে হত্যার হুমকি দিয়ে পদত্যাগ দাবি করে। তাঁর মসজিদে নামাজ আদায়ে বাধা সৃষ্টি করে। খলিফার বাসার খাবার ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। যিনি একদিন বীরে রুমা কূপটি ওয়াক্ফ করে মদিনাবাসীর পানির কষ্ট দূর করেছিলেন, তাঁর বাড়িতে সেই কূপের পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এক পর্যায়ে শত্রুরা খলিফার বাড়িতে ঢুকে পড়ে। এর পর রোজা থাকা অবস্থায় কোরআন তিলাওয়াতরত খলিফাকে তারা হত্যা করে। দিনটি ছিল হিজরি ৩৫ সনের ১৮ জিলহজ।
দায়িত্ব নেওয়ার ১২ বছর পর তাঁর খিলাফতের সমাপ্তি ঘটে। মদিনার জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।