আজ তৃতীয় তারাবিহতে পবিত্র কোরআনের সুরা আল ইমরানের ৯২ থেকে সুরা নিসার ৮৭ নম্বর আয়াত পর্যন্ত তিলাওয়াত করা হবে। চতুর্থ পারার পুরোটা ও পঞ্চম পারার প্রথম অর্ধেক—মোট দেড় পারা। আজকের তারাবিহতে বদর যুদ্ধ, ওহুদ যুদ্ধ, ইসলামের দাওয়াত, উত্তরাধিকার, এতিমের অধিকার, বিয়েশাদি, পারিবারিক বিরোধ মীমাংসা, মৃত্যু, হাশর, আসমান-জমিন সৃষ্টি, দাম্পত্য জীবন, মুমিনদের বারবার পরীক্ষার কারণ, আমানত আদায়, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, জিহাদ পালনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা রয়েছে।
কারা শ্রেষ্ঠ মানুষ
আল্লাহ তাআলা মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতদের শ্রেষ্ঠ উম্মত বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যাদের মধ্যে তিনটি গুণ থাকবে, তারাই হবে শ্রেষ্ঠ মানুষ; যেমন এক. সৎ কাজের আদেশ করা। দুই. অন্যায় কাজে বাধা দেওয়া। তিন. আল্লাহর প্রতি ইমান রাখা। (সুরা আল ইমরান, আয়াত: ১১০)
বদর যুদ্ধ বদলে দিল ইতিহাস
ইসলামের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল এক অধ্যায় বদর যুদ্ধ। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান মদিনার উপকণ্ঠে বদর নামক স্থানে কাফিরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের এ যুদ্ধ হয়। এটি ছিল ইসলাম ও মুসলিমদের অস্তিত্বের সংগ্রাম। অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই। অবিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিশ্বাসের যুদ্ধ। পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দেওয়ার যুদ্ধ। এ যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনীর ১ হাজার সশস্ত্র সেনা, ১০০ ঘোড়া ও ৭০০টি উট ছিল। ৩১৩ জন মুসলমানদের সঙ্গে ছিল মাত্র ২টি ঘোড়া ও ৭০টি উট। আল্লাহ মুসলমানদের বিজয় দেন। কাফিররা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এতে কুরাইশদের ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন বন্দী হয়। মুসলিমদের ১৪ জন শহীদ হন। এ যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে পৃথিবীজুড়ে মুসলমানদের নাম পড়ে। অবিশ্বাসীদের টনক নড়ে ওঠে। মদিনায় মুসলমানদের অবস্থান মজবুত হয়। সুরা আল ইমরানের ১২১ থেকে ১২৯ নম্বর আয়াতে বদর যুদ্ধের আলোচনা রয়েছে।
সফলতার চার মূলনীতি
এ সুরায় সর্বশেষ আয়াতে আল্লাহ তাআলা সফলতার চারটি মূলনীতির কথা বলেছেন। এক. ধৈর্য ধারণ করা। দুই. শত্রুর মোকাবিলায় শত্রুর চেয়ে বেশি অবিচলতা ও বীরত্ব অবলম্বন করা। তিন. শত্রুর মোকাবিলায় নিজেকে প্রস্তুত রাখা এবং চার. সর্বাবস্থায় আল্লাহর ভয় অন্তরে পোষণ করা।
সুরা নিসায় নারীদের অধিকার
পবিত্র কোরআনের চতুর্থ সুরা নিসা। মদিনায় অবতীর্ণ এ সুরার আয়াত সংখ্যা ১৭৬। নিসা অর্থ নারী। এ সুরায় নারীর অধিকার, নারীর উত্তরাধিকার, দাম্পত্য জীবন, তালাক–সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা থাকায় এ সুরার নাম হয় সুরা নিসা।
সুরা নিসার ৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা স্ত্রীকে খুশি মনে মোহর দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। বিয়ে করার জন্য স্ত্রীকে মোহর প্রদান করা ফরজ। দেনমোহর একজন স্বামীর ওপর অর্পিত দায়িত্ব, একই সঙ্গে একজন স্ত্রীর অধিকার ও সম্মান। বিয়ের আগে মোহর দিতে হবে। তবে স্ত্রীর সম্মতিক্রমে পরেও দেওয়া যেতে পারে। দুই পক্ষের আলাপের ভিত্তিতে মোহরানার পরিমাণ নির্ধারণ করা উত্তম। তবে বরের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে দেনমোহর ঠিক করা শ্রেয়। সর্বনিম্ন ১০ দিরহাম কিংবা সমপরিমাণ সম্পদ মোহরানায় ধার্য করতে হবে। উত্তরাধিকারীদের ঠকালে ইবাদত কবুল হয় না।
সুরা নিসার ১১ থেকে ১৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা মিরাসের বিধিবিধান বর্ণনার পাশাপাশি নারী ও শিশুর উত্তরাধিকারের অধিকার নিশ্চিত করেছেন। ইসলামের প্রায় বিধানের মূলনীতি আল্লাহ তাআলা নিজে কোরআনে বলে দিয়ে শাখাগত খুঁটিনাটি বিধান নবীর মাধ্যমে মানুষকে জানিয়েছেন। কিন্তু মৃতের পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টনের শাখাগত প্রায় সব খুঁটিনাটি বিধান আল্লাহ নিজে সরাসরি বলে দিয়েছেন। আত্মীয়ের নাম নিয়ে বলে দিয়েছেন, কে কতটুকু পাবে। জাহেলি যুগে নারী ও শিশুদের উত্তরাধিকার হিসেবে কিছুই দেওয়া হতো না। ইসলামের মাধ্যমে নারী ও শিশুদের উত্তরাধিকারের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো উত্তরাধিকারীদের সম্পদ থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করা হয়। কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর তাঁর সম্পদ থেকে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা, ঋণ আদায়, স্ত্রীর দেনমোহর আদায় এবং অসিয়ত তার প্রাপককে বুঝিয়ে দেওয়ার পর তাঁর অবশিষ্ট সম্পত্তি ইসলামি ফারায়েজ আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করা আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে কম–বেশি করা যাবে না। কাউকে ঠকানো যাবে না। মা, স্ত্রী ও কন্যাকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোনো সুযোগ নেই। ওয়ারিশ ঠকানো ও তাঁদের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা ভয়াবহ পাপ। ওয়ারিশ ঠকালে ইবাদত কবুল হয় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে অন্যায়ভাবে এক বিঘত পরিমাণ জমি দখল করবে, কিয়ামতের দিন সাত স্তবক জমিন তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।’ (মুসলিম, হাদিস: ১৬১০)
যে ১৪ শ্রেণির নারীকে বিয়ে করা হারাম
১৪ শ্রেণির নারী আছেন, যাঁদের সঙ্গে রক্ত, দুধ কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে বিয়ে করা যায় না। সুরা নিসার ২৩ থেকে ২৫ নম্বর আয়াতে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। ১৪ শ্রেণির নারী হলো মা, দাদি ও নানি, কন্যা, সহোদর বোন, আপন ফুফু, আপন খালা, আপন ভাতিজি, আপন ভাগনি, দুধমা, দুধবোন, শাশুড়ি, স্ত্রী পক্ষের কন্যা, পুত্রবধূ এবং একসঙ্গে দুই বোন।
৭টি মৌলিক হক
সুরা নিসার ৩৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে সাতটি মৌলিক হক যথাযথভাবে পালনের আদেশ করেছেন; যেমন এক. আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক না করা, দুই. মা-বাবা, তিন. নিকটাত্মীয়, চার, এতিম-মিসকিন, পাঁচ. প্রতিবেশী, ছয়. অসহায় মুসাফির ও সাত. নিজের অধীনস্থদের সঙ্গে সদাচরণ করা। একজন প্রকৃত মুমিনের গুণ হলো, এই হক আদায় করা এবং তাঁদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা। পাপী, দাম্ভিকেরা এই হক আদায় করে না। আল্লাহ দাম্ভিকদের পছন্দ করেন না।
আবু আশফাক মুহাম্মাদ : লেখক ও আলেম