রোজার তাৎপর্য, ইতিহাস ও উদ্দেশ্য
বছরের বিভিন্ন সময়ে রোজা রাখলেও কেবল রমজান মাসের রোজা পালন করা ফরজ। রোজা কেবল উম্মতে মুহাম্মাদ জন্য ফরজ নয়, বরং তা অতীত নবী-রাসুলদের উম্মতদের জন্যও ছিল। কিন্তু রোজার সময়, পদ্ধতি ও ধারা ভিন্ন ছিল।
রোজা ফারসি শব্দ, অর্থ উপবাস থাকা। কোরআন-হাদিসে এটিকে সিয়াম বলে। রোজা শব্দটিই প্রচলিত। সাওম বা সিয়াম শব্দের অর্থ বিরত থাকা। শরিয়তের পরিভাষায়, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাওয়া, পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকাকে সাওম, সিয়াম বা রোজা বলে।
কোরআন যে আয়াতটির মাধ্যমে রোজা ফরজ হয়, সেটিতেই ইঙ্গিত রয়েছে যে পূর্ববর্তী জাতি-গোষ্ঠীর জন্য রোজা ফরজ ছিল। আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ, তোমাদের জন্য সিয়াম (রোজা) বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা সাবধান হয়ে চলতে পারো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৩)।
আদম (আ.)-এর সময় আইয়ামে বিজ বা প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখতে হতো। ‘আইয়ামে বিজ’ অর্থ শুভ্রতার দিনসমূহ। আদম ও হাওয়া (আ.) জান্নাতে থাকাকালে নিষিদ্ধ ফল খেয়ে ফেলায় তাঁদের গায়ের রং কালো হয়ে যায়। তাই ফেরেশতারা তাঁদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তাঁরাও তওবা করেন। ফলে তাঁদের গায়ের রং সাদা ও সুন্দর হয়। এরপর আল্লাহ আদম (আ.) ও তাঁর উম্মতকে প্রতি মাসে তিনটি করে রোজা রাখার নির্দেশ দেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘মহানবী (সা.) আইয়ামে বিজের সিয়াম পালন করতেন।’ (নাসায়ি)
নুহ (আ.)-এর যুগেও রোজা পালন করা হতো। মহানবী (সা.) বলেন, ‘নুহ (আ.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা ছাড়া গোটা বছর রোজা রাখতেন।’ (ইবনে মাজাহ)। মহানবী (সা.) আরও বলেন, ‘নুহ (আ.)-এর যুগ থেকে প্রতি মাসে তিনটি করে রোজা ছিল।’ (ইবনে কাসির)
মুসা (আ.)-এর উম্মতের জন্য আশুরার রোজা ফরজ ছিল। মহানবী (সা.) মদিনায় আসার পর ইহুদিদের আশুরার রোজা পালন করতে দেখে এর কারণ জিজ্ঞাসা করেন। তারা বলল, ‘এটি এক শুভ দিন। এই দিনে আল্লাহ বনি ইসরাইলকে তাদের শত্রু থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। ফলে মুসা (আ.) আল্লাহর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ওই দিনে রোজা রাখেন।’ এ কথা শুনে মহানবী (সা.) বলেন, ‘তাহলে আমি হজরত মুসা (আ.)-এর অনুসরণে তোমাদের তুলনায় বেশি হকদার।’ (বুখারি)। এরপর মহানবী (সা.) আশুরার রোজা রাখেন এবং সাহাবিদের রোজা রাখার নির্দেশ দেন। এরপর রমজানের রোজা ফরজ হলে আশুরার রোজা নফলে পরিণত হয়।
দাউদ (আ.) বছরে ছয় মাস রোজা রাখতেন আর ছয় মাস রোজা রাখতেন না। মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় রোজা হলো দাউদ (আ.)-এর রোজা। তিনি এক দিন রোজা রাখতেন এবং এক দিন বিনা রোজায় অতিবাহিত করতেন।’
ঈসা (আ.)-এর উম্মতের সময়েও রোজার প্রচলন ছিল। ঈসা (আ.)-এর যখন জন্ম হয়, তখন লোকজন তাঁর মা মরিয়মকে তাঁর জন্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি করুণাময়ের উদ্দেশ্যে রোজা পালনের মানত করেছি। তাই আজ আমি কিছুতেই কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলব না।’ (সুরা মরিয়ম, আয়াত: ২৬)।
ঈসা (আ.) জঙ্গলে ৪০ দিন রোজা রেখেছিলেন। একবার ঈসা (আ.)-এর উম্মতরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আমরা পাপ আত্মাকে কীভাবে বের করব?’ তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘দোয়া ও রোজা ছাড়া তা অন্য কোনো উপায়ে বের হতে পারে না।’
জাহিলি যুগের লোকজন আশুরার রোজা পালন করত। ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘অন্ধকার যুগের লোকজন আশুরার রোজা পালন করত। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে মহানবী (সা.) নিজে আশুরার রোজা পালন করেছেন। এরপর যখন রমজানের রোজা ফরজ হয়, তখন মহানবী (সা.) বলেন, ‘আশুরা দিনে যে চায় সে ওই দিন রোজা রাখবে এবং যে চায় সে ওই দিন রোজা পরিহার করবে।’ (বুখারি)
রমজানের রোজা পালন ফরজ করে আল্লাহ বলেন, রমজান মাস, এতে মানুষের পথপ্রদর্শক ও সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং ন্যায় ও অন্যায়ের মীমাংসারূপে কোরান অবতীর্ণ হয়েছিল। অতএব, তোমাদের মধ্যে য কেউ এ মাস পাবে, সে যেন এ মাসে অবশ্যই রোজা রাখে। আর যে রোগী বা মুসাফির তাকে অন্য দিনে এ সংখ্যা পূরণ করতে হবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তোমাদেরকে কষ্ট দিতে চান না, যাতে তোমরা নির্ধারিত দিন পূর্ণ করতে পার ও তোমাদের সৎপথে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করতে পার, আর তোমরা কৃতজ্ঞ হলেও হতে পার। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫)
আয়াতটি দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে অবতীর্ণ হয়। তারপর ফরজ রোজা চালু হয়।