অধ্যাপক আবু বকর আল-সুলী (৩৩৯ হিজরি, ৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর আদাব আল-কাতিব গ্রন্থে এক আরব আর এক পার্সির ঝগড়ার গল্প বলেছেন। পারসি লোকটি আরবকে বলছিল, ‘আমরা কখনো আপনাদের সাহায্য ছাড়া কিছু করিনি। আপনাদের রান্না, পানীয় আর শাসন ব্যবস্থাও একইভাবে রেখেছি। কিছুই বদলাইনি। এভাবে তো চলে না।’ আরব উত্তরে জানাল, ‘ধৈর্য ধরুন, এক হাজার বছর শাসন করার পর কিছু পরিবর্তন নিশ্চয় আনব, তখন আপনার সমস্যা হবে না।’
এই ধরনের বিতর্ক তখনকার সময়ে সভ্যতা ও সংস্কৃতির অভূতপূর্ব মিলনের চিত্র ফুটিয়ে তোলে। একই সঙ্গে তা রান্নার শিল্প কীভাবে সভ্যতার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, তা-ও চিত্রায়িত করে।
আদি খাদ্যসংস্কৃতি
আরবরা আদিতে এমন একটি পরিবেশে বাস করত, যেখানে খাদ্যের প্রাপ্যতা ছিল সীমিত। তখন তাদের প্রধান খাবার ছিল সারিদ। সারিদ ছিল এক ধরনের পিঠা, মাংসের স্যুপে ভিজিয়ে খাওয়া হতো। আর ছিল শাওয়া বা পোড়ানো মাংস। তাদের জীবনযাত্রায় এই খাদ্যগুলো ছিল সাধারণ ও সহজলভ্য। এ ধরনের খাবারকে ‘ফাঈলাহ’ বা ‘অসাধারণ’ নামে ডাকা হতো। আবু মনসুর আল-সিয়ালবি তাঁর ফিকহ আল-লুগা গ্রন্থে আরও তিনটি ‘ফাঈলাহ’ খাবারের সন্ধান দিয়েছেন, যেমন সাখিনাহ নামে মাংসের স্যুপ, আসিদাহ নামে এক ধরনের পরিজ ও হরিরাহ নামে এক ধরনের ঝোলের তরকারি।
তীব্র খরা হলে আরবদের অনাহারে কাটাতে হতো। তাই তারা সে-সময় খাবার হিসেবে যে কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে প্রস্তুত ছিল। এমনকি গৃহপালিত প্রাণীও ছিল তাদের খাদ্য তালিকায়।
মুসলিম বিজয়ের পর
ইসলামি যুগে, বিশেষত উমাইয়া ও আব্বাসি শাসনামলে আরবরা রোমান ও ফারসি সভ্যতার রন্ধন কৌশল গ্রহণ করে এবং এর সঙ্গে তাদের নিজস্ব রান্নার ধরন বিকশিত করে। মুসলিম বিজয়ের ফলে বিশেষত শাম ও ইরাক অঞ্চলে খাবার সংস্কৃতি ও রান্নার পদ্ধতিতে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। নতুন অঞ্চল আওতায় এলে মুসলিমরা সেখানকার উপাদান ও রান্নার পদ্ধতি গ্রহণ করত, ফলে তাদের খাবারের সংস্কৃতি এবং রান্নার পদ্ধতি ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হতে থাকে।
তবে মুসলিমরা শুধুমাত্র বিদেশি সংস্কৃতির নকল করেনি, বরং তারা নতুন নতুন রান্নার প্রকরণ তৈরি করতে শুরু করে। তারা খাবারে তখন স্বাস্থ্য, শক্তি ও পুষ্টির দিকটি বিবেচনায় রাখত। শাসন ব্যবস্থা ও খাবারের প্রভাব ছিল একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। মুসলিমদের রচিত বিভিন্ন রান্নার বইয়ে আমরা দেখি, যেসব মসলার ব্যবহার করা হতো, তাতে বিভিন্ন উপাদান এবং প্রক্রিয়ার বিবরণে অনেক বেশি বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব আসে।
আব্বাসি যুগের উদ্ভাবন
আব্বাসি আমলে রান্নার শৈলী আরও উন্নত ও উদ্ভাবনী হয়ে ওঠে। খাবার তখন প্রয়োজনের সীমা ছাড়িয়ে সাংস্কৃতিক ও আর্থিক পরিসরে জড়িয়ে পড়ে। মুসলমানরা খাবারের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য নিয়ে রীতিমতো গবেষণায় নেমে পড়ে। খাদ্যের উপকারিতা ও ক্ষতি এবং সঠিক রান্নার পদ্ধতি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়, এমনকি নতুন নতুন রেসিপি ও নিয়মকানুন সামনে চলে আসে।
এই সময়ে মুসলিমরা খাবারের মান নিয়ন্ত্রণেও সচেতন ছিল। হিসবা (ভোক্তা সুরক্ষা) ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা খাবারের গুণগত মান এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার জন্য নিয়মাবলি প্রণয়ন করে। খাবারের নিরাপত্তা ও সততা বজায় রাখার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। রোগ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের জন্য নির্দিষ্ট মাংস রান্নার পরামর্শ থাকত। যেমন গরু, উট ও ছাগলের মাংস একসঙ্গে না মেশানো, যাতে পুনরায় কেউ অসুস্থ না হন।
নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাওয়ায় খাবারের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়তে থাকে এবং এর ফলস্বরূপ শরাহ (অতি খাওয়া) প্রবণতা দেখা দেয়।
খাদ্যরসিক মুয়াবিয়া (রা.)
কামালুদ্দিন আল-দামিরি (৮০৮ হিজরি, ১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর হায়াতুল হাইওয়ান গ্রন্থে একটি পরিবর্তন তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘উমাইয়া যুগে খাবারের প্রতি এই আগ্রহ প্রথম দিকে ততটা ছিল না, ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। প্রথম যে ব্যক্তি ফারসি সংস্কৃতির অনুকরণ গ্রহণ করেছিলেন, তিনি মুয়াবিয়া ইবনে আবু সাফিয়ান (রা.)। তিনি খাদ্য ও পানীয়ের ক্ষেত্রে এক নতুন বিলাসিতার সূচনা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে অন্যান্যা খলিফারাও এই রীতি অনুসরণ করে।’
আল-মাসউদি (৩৪৬ হিজরি, ৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দ) মুরুজ আল-যাহাব গ্রন্থে মুয়াবিয়া (রা.) খাদ্যাভ্যাসের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে লেখেন, ‘মুয়াবিয়া (রা.) দিনে পাঁচবার খেতেন। শেষ খাবার ছিল সবচেয়ে ভারী, তারপর বলতেন, আরে, আমাকে ওঠাও। আমি মনমতো খেতে পারিনি। কিন্তু বিরক্ত হয়ে গেছি!’
ইমাম ইবনে কাসির (৭৭৪ হিজরি, ১৩৭২ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে মুয়াবিয়ার পরিচিতিসহ বলেন, ‘তিনি ছিলেন দামেস্কের শাসক। দিনে সাতবার খেতেন। খাবারে প্রচুর মাংস ও মিষ্টি রাখতেন। এত খাওয়ার পরেও তিনি বলতেন, আমি কখনো পেটভরে খাই না, শুধু ক্লান্ত হয়ে যাই আর কি!’
মুয়াবিয়ার (রা.)এই অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা তাকে শারীরিক ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয় এবং তাকে স্বাস্থ্যগত সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যাকে খাদ্যাভ্যাসের কারণে খাবারের উপাদান পর্যালোচনা করার জন্য ডাক্তার ডাকতে হয়। ডাক্তার তাকে কী খাবেন, কী খাবেন না, সে পরামর্শ দিতেন। কিন্তু তা মুয়াবিয়া (রা.) থোড়াই কেয়ার করতেন।
মুসলিম সমাজে রান্নার উন্নতি
রান্নার প্রসারে তখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ইসলামি শাসন এবং পূর্বতন পারস্য ও রোমান সংস্কৃতির মধ্যকার মেলবন্ধন। বিশেষত মুসলিম শাসকদের হেঁশেলে যে বিপুল ও বৈচিত্র্যময় রান্নার আবির্ভাব ঘটে, তা-ই মধ্যযুগে মুসলিম সভ্যতায় রন্ধনশিল্পকে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করে।
উমাইয়া শাসক সুলাইমান ইবনে আবদুল মালিক (৯৯ হিজরি, ৭১৯ খ্রিষ্টাব্দ) ও হিশাম ইবনে আবদুল মালিকের (১২৫ হিজরি, ৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) মতো বহু শাসক তাঁদের বিপুল খাদ্যাভ্যাসের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। শামসুদ্দিন আল-যাহাবি সিয়ারু আলাম আন-নুবালা গ্রন্থে সুলাইমান ইবনে আবদুল মালিকের অতিমাত্রায় খাবার গ্রহণের ইতিহাস উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘তিনি একবার ৪০টি মুরগি এবং ৭০টি আঙুর খেয়েছিলেন’।
আলজাজিরা ডট নেট অবলম্বনে