আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ দলিল মদিনা সনদ

শান্তির দূত বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রথম আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি মদিনা ও এর পাশের অঞ্চলগুলোর মুসলমান এবং নানা ধর্মের ও নানা বর্ণের লোকদের নিয়ে একটি সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন, যা জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে সবার মানবিক, সামাজিক, নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

যে ঐতিহাসিক ঘোষণার মাধ্যমে এই বহুজাতিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, ইতিহাসে তা ‘মদিনা সনদ’ নামে পরিচিত। এটি মানবসভ্যতার প্রথম লিখিত রাষ্ট্রীয় সংবিধান। এ চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল সংঘাতের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, অত্যাচারিত–নিপীড়িতকে সাহায্য করা এবং চুক্তিভুক্ত সব পক্ষের মানমর্যাদা ও ধর্মবিশ্বাসের অধিকার সংরক্ষণ।

মদিনা সনদ মানবসভ্যতায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনে বিরাট পরিবর্তন সাধন করে। এটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নৈরাজ্য, সংঘাত, যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ করে যুদ্ধবাজ গোত্রগুলোর মধ্যে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন তৈরি করে

মদিনা সনদ মানবসভ্যতায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনে বিরাট পরিবর্তন সাধন করে। এটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নৈরাজ্য, সংঘাত, যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ করে যুদ্ধবাজ গোত্রগুলোর মধ্যে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন তৈরি করে।

মদিনা সনদের গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ

১. কুরাইশ ও মদিনার মুমিন মুসলমানরা এবং যাঁরা তাঁদের অনুগামী হয়ে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হবেন, তাঁরা অন্যদের থেকে ভিন্ন একটি (ভৌগোলিক) জাতি হিসেবে পরিগণিত হবে।

২. মুসলমানরা, বনু আওফ ও তাদের মিত্ররা, বনু নাজ্জার, বনু হারেস, বনু খাজরাজ, বনু আওস ও তাদের মিত্ররা, বনু সায়েদাহ, বনু জুশাম, বনু আমর ইবন আওফ, বনু নাবিত, বনু সালাবাহ ও তাদের মিত্ররা, জুফনা উপগোত্র, বনু শুতাইবাহ ও চুক্তিবদ্ধ সব ধর্ম সম্প্রদায় ও তাদের মিত্ররা সবাই তাদের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তায় সমান অধিকার পাবে। সবাই সবার সঙ্গে ন্যায়সংগত আচরণ করবে।

৩. যে ব্যক্তি জুলুম করবে, সে নিজেকে ধ্বংস করবে। যে ব্যক্তি কোনো অপরাধ করবে, সে তার জন্য দায়ী হবে। অবশ্যই অঙ্গীকার পূর্ণ করতে হবে, তা ভঙ্গ করা যাবে না। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি প্রতিকার পাবে। মজলুম তার নিজের প্রতিরক্ষা করতে পারবে। চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলো নিজেদের মধ্যে পরামর্শ ও কল্যাণকামিতা বজায় রাখবে। প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে, তা ভঙ্গ করবে না। মজলুমকে সবাই সাহায্য করবে। এই চুক্তির পক্ষগুলোর জন্য মদিনা একটি সংরক্ষিত ও পবিত্র নগর হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রতিবেশীকে নিজের মতোই গণ্য করতে হবে, তার কোনো ক্ষতি বা তার প্রতি কোনো অপরাধ সংঘটন করা যাবে না। যে ব্যক্তি এই চুক্তির প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে, আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেন। কারও ওপর কোনো হামলা হলে অথবা জুলুম করা হলে বা কোনো অন্যায় ও সীমা লঙ্ঘন হলে অথবা মুমিনদের মধ্যে বিপর্যয়–বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাইলে সবাই সম্মিলিতভাবে তা প্রতিহত করবে। নিশ্চয় মুমিনগণ স্বতন্ত্রভাবে পরস্পরের মিত্র। কারও প্রতি কোনো অবিচার করা হবে না। কেউ গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া কোনো মুমিনকে হত্যা করলে, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।

মদিনাকে কেউ আক্রমণ করলে চুক্তির সব পক্ষ পারস্পরিক সাহায্যের মাধ্যমে তা প্রতিহত করবে। এই চুক্তিপত্রের পক্ষগুলো থেকে তারা বিশ্বস্ত ও কল্যাণকামী আচরণ পাবে। কেউ কোনো বিরূপ কর্মতৎপরতায় জড়িত হলে তা তার ওপরেই বর্তাবে। এই সনদ কোনো জালিম বা অপরাধীকে রক্ষা করবে না।

এই চুক্তির পক্ষগুলোর মধ্যে যদি এমন কোনো পরিস্থিতি বা মতানৈক্যের উদ্ভব হয়, যাতে এই চুক্তি

নস্যাৎ হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়; সে ক্ষেত্রে ফয়সালার

জন্য আল্লাহ ও মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে, অর্থাৎ কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী সমাধান করবে।

নিশ্চয়ই আল্লাহ এই চুক্তির বিষয়াদির সত্যনিষ্ঠ বাস্তবায়নকারী ও প্রতিশ্রুতি পালনকারীদের সঙ্গে আছেন। (বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় ইমাম ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের করণীয়, পৃষ্ঠা: ৯৩-১০৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]