প্রতিটি দেশে রমজান নিজস্ব ঐতিহ্য ও পরিবেশ নিয়ে আসে। তবে জার্মানির মতো বহু সাংস্কৃতিক সমাজে এটি এক অনন্য রূপ ধারণ করে। মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্গে আধুনিক ইউরোপীয় জীবনের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করে নেন। জার্মানিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ গঠিত হয়েছে আরব, তুর্কি, পাকিস্তানি, আফ্রিকানসহ নানা জাতিগোষ্ঠী থেকে। তাই রমজানের সময় বার্লিন, কোলোন, মিউনিখসহ বড় শহরগুলোর মসজিদগুলো হয়ে ওঠে কমিউনিটির হৃৎস্পন্দন। বিভিন্ন পটভূমি থেকে আসা মানুষ একত্রিত হয়ে ইবাদত এবং আত্ম-অনুসন্ধানের মাধ্যমে সময় অতিবাহিত করেন। তারাবির সময় মসজিদগুলো ভরে যায় মুসল্লিদের কণ্ঠে। আরবি, তুর্কি ও অন্যান্য ভাষায় খুতবা দেওয়া হয়, ফলে বহুজাতিক মুসলিম সমাজের চিত্র ফুটে ওঠে।
রোজার মাসে মানিয়ে নেওয়ার কৌশল
জার্মানিতে মুসলিমরা নিজেদের জীবনযাত্রার সঙ্গে রোজার সময়সূচিকে মানিয়ে নেওয়ার বিভিন্ন উপায় খুঁজে নেন। অনেকেই হালকা সাহরি গ্রহণ করেন, যাতে সারা দিন কাজ বা পড়াশোনার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি বজায় থাকে। তবে রমজান শুধুমাত্র একটি ক্যালেন্ডারের মাস নয়, বরং এটি একটি আত্ম-অনুসন্ধানের অভিজ্ঞতা, যেখানে মানুষ নিজের দৈনন্দিন অভ্যাসকে পুনর্গঠন করে।
ঘরোয়া পরিবেশ ও ইফতার আয়োজন
শুধুমাত্র মসজিদকেন্দ্রিক নয়, রমজানে পরিবারের ভেতরেও এক বিশেষ পরিবেশ তৈরি করে। গৃহস্থালিতে ইফতার টেবিল হয়ে ওঠে সংস্কৃতির মিশ্রণে সমৃদ্ধ। তুরস্কের খাবার, মরক্কোর বিশেষ পদ, শামের ঐতিহ্যবাহী রান্নার সঙ্গে ইউরোপীয় উপাদানের মিশেল থাকে। খেজুর ও স্যুপ রমজানের প্রধান খাবার হিসেবে অপরিহার্য, তবে ইফতারে কখনো কখনো ফালাফেলের সঙ্গে শ্নিৎসেল নামে জার্মান রুটি পরিবেশিত হয়।
সম্মিলিত ইফতার আয়োজন
বড় শহরগুলোতে গোষ্ঠীগত ইফতার আয়োজন খুবই জনপ্রিয়। মসজিদ, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বা পার্কে খোলা জায়গায় আয়োজন করা হয় সম্মিলিত ইফতারের। অমুসলিম প্রতিবেশীদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়, খাবার ও অনুভূতি পরস্পরের মাঝে ভাগাভাগি করা হয়। এই সময় একাকিত্ব বদলে যায় প্রশান্তিতে, আর ক্ষুধার অনুভূতি পরিণত হয় আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষায়।
রমজানের বাজার ও সংস্কৃতির প্রতিফলন
জার্মানির রাস্তাগুলোতে ঐতিহ্যবাহী রমজানের বাজার থাকে না বটে, তবে কোনো কোনও শহরে ছোট ছোট আয়োজন থাকে। বার্লিনে অস্থায়ী স্টল বসে, যেখানে আরবীয় মিষ্টি যেমন বাকলাভা, কাতায়েফ এবং তুর্কি বোরেক বিক্রি হয়। আরব ও তুর্কি স্টোরগুলোর চাহিদা বেড়ে যায়। মানুষ ইফতার ও সাহরির জন্য বিশেষ খাবার ও রমজানের সাজসজ্জা কিনতে ভিড় করে।
জীবনযাত্রা ও রোজার ভারসাম্য
জার্মানিতে রোজা রাখা সহজ নয়, যেহেতু দিন বেশ দীর্ঘ হয়। গ্রীষ্মকালে রোজার সময় ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে, ফলে কর্মজীবীদের জন্য বিশেষ চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। এ-বছর রমজান মার্চ মাসে পড়ায়, রোজার সময় প্রায় ১৩ ঘণ্টা, তাই তুলনামূলক সহনীয়। তবে এত দীর্ঘ সময় উপবাস থাকা সত্ত্বেও মুসলমানরা কাজ ও পড়াশোনার সঙ্গে রোজার সময়সূচি মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন।
প্রবাসে আত্মপরিচয়ের সন্ধান
একদিকে রমজান আধ্যাত্মিক সংযোগের মাস, মানুষ ধর্মীয় অনুভূতিকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করে। অন্যদিকে তা সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের উদাহরণ। মুসলমানরা তাদের ঐতিহ্য রক্ষা করেও ইউরোপীয় সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। রমজান সেখানে শুধু ধর্মীয় চর্চা নয়, এটি একধরনের আত্ম-উপলব্ধি, যা মানুষকে তার শেকড় ও আত্মার সঙ্গে সংযুক্ত করে রাখে। হয়তো এখানে ঐতিহ্যবাহী বাজারের কোলাহল নেই, টেলিভিশনের রমজান স্পেশাল সিরিজের উৎসব নেই, কিন্তু আধ্যাত্মিক সংযোগ, মানবিক উষ্ণতা ও সমন্বয়ের শক্তি এখানকার রমজানকে বিশেষ করে তোলে। এটি এমন এক মাস, যেখানে মুসলমানরা নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েও তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বজায় রাখতে সক্ষম হন। জার্মানিতে রমজান তাই শুধু ত্যাগের নয়, বরং নতুন উপলব্ধি ও সংযোগের এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
সূত্র: আলজাজিরা ডট নেট