আজ খতমে তারাবিহতে সুরা বাকারার ২০৪ থেকে সুরা আলে ইমরানের ৯১ নম্বর আয়াত পর্যন্ত পড়া হবে। পারা হিসেবে দ্বিতীয় পারার শেষার্ধ ও তৃতীয় পারার পুরো অংশ তিলাওয়াত করা হবে। এই অংশে মদ, জুয়া, এতিমদের সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, আল্লাহর মহত্ত্ব, সুদ, স্ত্রীর অধিকার, ঈসা (আ.)-এর জন্ম, রাত ও দিনের বিবর্তন, জীবন ও মৃত্যুর রহস্য, মাতৃগর্ভে মানুষের আকার-আকৃতি, তালুত (আ.) ও জালুতের যুদ্ধের কাহিনি, ঋণ দেওয়ার পদ্ধতি, নবীর প্রতি ভালোবাসা, নবী-রাসুলদের দাওয়াত, জাহান্নামের আজাব ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা রয়েছে। মদ ও জুয়া অপরাধের আকর। এতে চক্রবৃদ্ধি হারে অপরাধের শৃঙ্খল তৈরি হয়। এতে মানুষের শারীরিক, মানসিক, চারিত্রিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে বিপর্যয় নেমে আসে। মদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে এমন ১০ শ্রেণির মানুষের ওপর রাসুলুল্লাহ (সা.) অভিসম্পাত করেছেন। যেমন যে নির্যাস বের করে, প্রস্তুতকারক, পানকারী, পরিবেশনকারী, আমদানিকারক, যার জন্য আমদানি করা হয়, বিক্রেতা, ক্রেতা, সরবরাহকারী এবং এর লভ্যাংশ ভোগকারী। (তিরমিজি)
নারীর মর্যাদা ও অধিকার
এই সুরার ২২২ থেকে ২৪২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা নারীসম্পর্কিত বিধিবিধান, নারীর মর্যাদা ও অধিকারের কথা বলেছেন। ঋতু চলাকালে স্বামী-স্ত্রীর মেলামেশা নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তাআলার কাছে তালাক ঘৃণিত বিষয় হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ অবস্থায় একান্ত বাধ্য হলে তালাকের অনুমোদন দিয়েছেন। স্ত্রীর অধিকার হিসেবে মোহর নির্ধারণ করেছেন। নারীদের জীবজন্তুর মতো বেচাকেনা হতো। তাদের স্বাধীনতা ছিল না। বিয়ের ব্যাপারে তাদের মতামত কিংবা পছন্দের মূল্য ছিল না। সম্পদ বা মিরাসের উত্তরাধিকারী পেত না। ধর্ম-কর্মেও তাদের অংশ ছিল না। নিজ ঘরেই পরিত্যক্ত আসবাবের মতো বিবেচিত হতো। তাদের নিজস্ব স্বত্ব বলতে কিছু ছিল না। ইসলাম এসে নারীকে মর্যাদা ও অধিকারের মসনদে বসিয়েছে। তাকে স্বাধীনতা দিয়েছে। সম্পদের উত্তরাধিকারী বানিয়েছে। ধর্ম-কর্মে উৎসাহিত করেছে।
তাকে মানুষ হিসেবে সম্মানিত করেছে। সংসারজীবনে স্ত্রীর ওপর যেমন স্বামীর অধিকার আছে, তেমনি স্বামীর ওপর আছে স্ত্রীরও। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যেমন কিছু কর্তব্য আছে, স্বামীর প্রতি আছে স্ত্রীরও। সম্মান উভয়ের আছে। আল্লাহ বলেন, ‘আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের ওপর অধিকার রয়েছে, তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের ওপর নিয়ম অনুযায়ী।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২২৮)
শ্রেষ্ঠ আয়াত আয়াতুল কুরসি
সুরা বাকারার ২৫৫ নম্বর আয়াতের নাম আয়াতুল কুরসি। এটি কোরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ আয়াত। (মুসলিম, হাদিস: ১৩৯৬) এর মধ্যে ৫০টি শব্দ ও ১০টি বাক্য আছে। এ আয়াতে আল্লাহর একত্ববাদ, মর্যাদা ও গুণের বর্ণনা রয়েছে। এ আয়াত পাঠে অনেক ফজিলত আছে। আছে জান্নাতে যাওয়ার সুসংবাদ। এটি অভাব দূর হওয়ার পাথেয়। শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে বেঁচে থাকার পথ্য।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি নিয়মিত পাঠ করে, তার জন্য জান্নাতে প্রবেশের পথে একমাত্র মৃত্যু ছাড়া অন্য কোনো বাধা থাকে না।’ (নাসায়ি, হাদিস: ৯৯২৮)
কোরআনের ২৮২ আয়াতে অর্থনৈতিক লেনদেনের কথা রয়েছে । এ আয়াতে ব্যবসা-বাণিজ্য, পরস্পর লেনদেন ও বন্ধকের বিধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা রয়েছে। যেমন এক. বাকিতে লেনদেন হলে কাগজে লিখে নিতে হবে। দুই. বাকিতে লেনদেনের ক্ষেত্রে মেয়াদ সুস্পষ্ট করে ঠিক করে নিতে হবে। তিন. লেখার কিছু না পেলে কোনো কিছু বন্ধক রাখতে হবে। চার. নগদ লেনদেনে লেখার প্রয়োজনীয়তা নেই।
সুরা আলে ইমরানে ইমরান পরিবারের গল্প
কোরআনের তৃতীয় সুরা আলে ইমরান। এটি মদিনায় অবতীর্ণ। এ সুরার আয়াতের সংখ্যা ২০০। আলে ইমরান অর্থ ইমরানের পরিবার। ইমরান (আ.)-এর পরিবার ও বংশধর সম্পর্কে এই সুরায় বিশেষভাবে বর্ণনা রয়েছে, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এর নাম রাখা হয়েছে আলে ইমরান। আল্লাহকে যে পেতে চায়, তার জন্য মহানবী (সা.)-এর আদর্শের বিকল্প নেই। আল্লাহকে ভালোবাসার পূর্বশর্ত হলো তাঁর অনুসরণ। হজরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীর ইতিহাসে সেরা মানুষ। তিনি উত্তম চরিত্রের অধিকারী। পৃথিবীর সব মানুষের জন্য তাঁর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। তাঁর আদর্শের অনুসরণ ও অনুকরণে জীবন বড় সুন্দর হয়। জীবনে কল্যাণ হয়।
পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কোরো, যাতে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসেন...।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১)
অলৌকিক তিন ঘটনা
এই সুরার ৩০-৬২ নম্বর আয়াতে শিক্ষণীয় তিনটি অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে।
এক. মরিয়ম (আ.)-এর জন্ম:
মরিয়ম (আ.)-এর পিতা ইমরান ছিলেন নেক ও পরহেজগার মানুষ। তাঁর মা হান্নাহ বিনতে ফাকুজ সচ্চরিত্রা ও সতীসাধ্বী নারী ছিলেন। তাঁরা দুজনই সৎকাজ এবং ভালো আচরণের জন্য বনি ইসরায়েলে সুবিদিত ছিলেন। কিন্তু দুজনকেই সন্তান না হওয়ার অপূর্ণতা কষ্ট দিত। দুজনই সন্তানের আকাঙ্ক্ষা করতেন। হান্নাহ একদিন এক পাখিকে তার বাচ্চাকে খাবার খাওয়াতে দেখলেন। এই দৃশ্য দেখে তাঁর ভেতর সন্তানের আগ্রহ তীব্র হয়ে উঠল। আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতি করে দোয়া করলেন। মানত করলেন, সন্তান হলে মসজিদুল আকসার খেদমতে ওয়াকফ করে দেবেন। (তাফসিরে আনওয়ারুল কোরআন, মাওলানা আবুল কালাম মাসুম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৪৫১)
আল্লাহ দোয়া কবুল করলেন। এক কন্যাসন্তানের জন্ম হলো। নাম রাখলেন মরিয়ম। কিন্তু মেয়েকে তো বায়তুল মাকদিসে খাদেম হিসেবে নেওয়া হয় না। হান্নাহ চিন্তায় পড়ে গেলেন। এর মধ্যে ইমরানও মারা গেলেন। এদিকে আল্লাহ মরিয়মের মাধ্যমে কোনো নারীকে মসজিদুল আকসার জন্য এই প্রথম কবুল করে নিলেন। সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ জাকারিয়া (আ.) পেলেন মরিয়মের ভরণপোষণ ও লালন-পালনের দায়িত্ব।
দুই. জাকারিয়া (আ.)-এর সন্তানলাভ:
মরিয়ম (আ.)-এর জন্য জান্নাত থেকে খাবার আসত। ফলমূল আসত। তিনি দিনমান আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতেন। এসব অলৌলিক কর্মকাণ্ড দেখে জাকারিয়া (আ.) বিমুগ্ধ ও বিস্মিত হলেন। তাঁর ভেতর সন্তানের প্রবল আগ্রহ জেগে উঠল। তাঁরও কোনো সন্তান ছিল না। আল্লাহর কাছে সন্তান চাইলেন। অথচ তিনি শতবর্ষী বৃদ্ধ। তাঁর স্ত্রীও বৃদ্ধা, উপরন্তু বন্ধ্যা। কিন্তু আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করে তাঁদের একটি পুত্রসন্তান দিলেন। নামও রেখে দিলেন ইয়াহইয়া।
তিন. ঈসা (আ.)-এর জন্ম:
মরিয়ম (আ.) তখন প্রাপ্তবয়স্ক নারী। আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে পৃথিবীতে পিতা ছাড়া সন্তান জন্মদানের ইচ্ছা করলেন। জিবরাইল (আ.)-কে তাঁর কাছে পাঠালেন। মরিয়ম (আ.) জিবরাইলকে দেখে ভয় পেয়ে বসলেন। জিবরাইল তাঁকে আল্লাহর ইচ্ছা জানালেন। তিনি অবাক হলেন। মানুষের সংযোগ ছাড়া সন্তান জন্মের ব্যাপারটি তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি গর্ভবতী হলেন। ঈসা (আ.)-এর জন্ম হলো। বনি ইসরাইল মরিয়মের ওপর অপবাদের তির ছুড়ল। এক দিনের শিশু ঈসা মায়ের পবিত্রতার ঘোষণা দিলেন।
আবু আশফাক মুহাম্মাদ: লেখক ও আলেম