উম্মে সালামা (রা.): ইসলামের প্রথম যুগের মহীয়সী নারী
উম্মে সালামার(রা.)পুরো নাম হিন্দ বিনতে আবু উমাইয়া ইবন আল-মুগীরা। তিনি ছিলেন রূপে ও গুণে অনন্য, অভিজাত বংশোদ্ভূত এবং অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এক মহান নারী। তাঁর স্বামী আবদুল্লাহ ইবন আবদ আল-আসাদ ছিলেন ইসলামের প্রাথমিক যুগের সাহসী সাহাবিদের একজন, যিনি রাসুল মুহাম্মদ (সা.)-এর গোপনে দাওয়াতকালে ইসলাম গ্রহণ করেন।
উম্মে সালামা (রা.) ও তাঁর স্বামী দুজনেই ছিলেন ইসলামের সূচনালগ্নের প্রথম দিককার অনুসারী। তাঁর স্বামী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচাতো ভাই, আর স্বামীর মা ছিলেন নবীর পিতৃপক্ষের ফুফু—আরওয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিব। এ দম্পতি ইসলামের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যারা আবিসিনিয়ায় (বর্তমান ইথিওপিয়া) হিজরত করেছিলেন, তাঁদের অন্যতম।
প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী উম্মে সালামা শিরক ও মূর্তিপূজার অযৌক্তিকতা অনুধাবন করে নিজ উদ্যোগে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবু উমাইয়া ছিলেন মক্কার এক সম্মানিত ব্যক্তিত্ব, যার উপাধি ছিল ‘যাদুর রকব’—অর্থাৎ ‘ভ্রমণকারীদের রসদদাতা’। কোনো সফরে গেলে তিনি তাঁর সঙ্গীদের খাবার আনতে দিতেন না; সকলের জন্য খাবারের ব্যবস্থাও তিনি নিজেই করতেন। এমন ছিল তাঁর উদারতা ও আতিথেয়তা।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসলাম প্রচারের শুরুতে তিন বছর গোপনে দাওয়াত দেন। পরে যখন তিনি প্রকাশ্যে প্রচার শুরু করেন, তখন তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েন। এরই প্রেক্ষিতে নবুওয়াতের পঞ্চম বছরে রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের একটি অংশকে আবিসিনিয়ায় হিজরতের পরামর্শ দেন।
ইতিহাস বলে, এই হিজরত দুর্বল ও নির্যাতিত মুসলিমদের আত্মরক্ষার একটি প্রচেষ্টা ছিল। তবে আবু সালামা ও উম্মে সালামা সহ বহু অভিজাত পরিবার এই দলে ছিলেন, যারা সামাজিকভাবে প্রভাবশালী ছিলেন ও নিজেদের রক্ষা করার সামর্থ্য রাখতেন। এর মানে, হিজরতের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন।
রাসুল (সা.) দুটি উদ্দেশ্যে সাহাবিদের আবিসিনিয়ায় পাঠান—প্রথমত, মক্কার উত্তেজনা প্রশমিত করা, দ্বিতীয়ত, ইসলামের বিশ্বজনীনতা প্রমাণ করা। তারা কেউ কয়েক মাস থেকে ফিরে আসেন, কেউবা সেখানে ১৫ বছর পর্যন্ত অবস্থান করেন। উম্মে সালামা ও তাঁর স্বামী আনুমানিক তিন থেকে চার বছর সেখানে ছিলেন। তাঁদের প্রথম সন্তান সালামা-র জন্মও হয় সেখানে।
তাঁরা মক্কায় ফিরে আসেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পাশে থেকে ইসলামের দাওয়াতে অংশ নিতে। কিন্তু মক্কার বিরোধীরা আরও নৃশংস হয়ে ওঠে—নবীজিকে উপহাস করে, মুসলিমদের ওপর নানা রকম নির্যাতন চালায়, এমনকি তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে।
এই প্রতিকূল পরিবেশেই ইসলাম নতুন আশ্রয় খুঁজে পায় ইয়াসরিবে (পরবর্তীতে মদিনা)। সেখানকার মানুষ প্রতিদিন ইসলাম গ্রহণ করছিল। এক পর্যায়ে তারা নবীজিকে ও মক্কার মুসলিমদের আমন্ত্রণ জানায় মদিনায় চলে আসার জন্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনার মুসলিমদের পূর্ণ সহযোগিতার অঙ্গীকার গ্রহণ করেন এবং সাহাবিদের হিজরতের নির্দেশ দেন।
উম্মে সালামা ও তাঁর স্বামীও হিজরত করেন, কিন্তু কিছুদিন পরেই তাঁর স্বামী ইন্তেকাল করেন।
তৎকালীন আরব সমাজে বহু সন্তানের জননী হওয়া বা বিধবা হওয়া পুনর্বিবাহে বাধা ছিল না। তাই ইদ্দত পূর্ণ হলে, তাঁর কাছে একাধিক প্রস্তাব আসে। আবু বকর ও উমর (রা.)-এর মতো বিশিষ্ট সাহাবিরাও বিবাহের প্রস্তাব দেন, কিন্তু উম্মে সালামা বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি স্বামীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং তাঁর অনুপস্থিতি গভীরভাবে অনুভব করছিলেন।
তিনি তাঁর স্বামীর কাছ থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি হাদিস শুনেছিলেন: ‘যে কেউ বিপদে পড়ে আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী এই দোয়া পড়ে—‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’—আল্লাহ তাকে সহায়তা করবেন এবং তার জন্য এর চেয়েও উত্তম কিছু দান করবেন।’ (মুসলিম, হাদিস: ৯১৮)
উম্মে সালামা (রা.) বলেন, ‘আমি এই দোয়া বারবার পড়তাম। কিন্তু ভাবতাম, আবু সালামার চেয়ে উত্তম আর কে হতে পারে?’ তবু আল্লাহর রহমতে সেটাই ঘটেছিল।
সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর এক মহান প্রস্তাব আসে—রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে তাঁকে বিয়ে করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। উম্মে সালামা সম্মানিত বোধ করলেও কিছুটা সংকোচবোধও করেন। তিনি বার্তা পাঠান: ‘আমি ঈর্ষাকাতর প্রকৃতির, বয়স হয়েছে এবং আমার অনেকগুলো সন্তান।’
এটি ছিল অস্বীকৃতি নয়, বরং বিনম্র অজুহাত। রাসুলুল্লাহ (সা.) উত্তরে বলেন, ‘তোমার ঈর্ষাভাব দূর করার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। বয়স? আমি তো তোমার চেয়ে বড়। আর তোমার সন্তানদের দায়িত্ব আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের কাছে অর্পণ করো।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ২,১০৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১,৯৪৩)
কার বিধবা সন্তানদের জন্য এর চেয়ে উত্তম অভিভাবক আর হতে পারে? এভাবেই এই সম্মানজনক বিয়েটি সম্পন্ন হয় এবং উম্মে সালামা (রা.) উপলব্ধি করেন—আল্লাহ তাঁকে এমন এক স্বামী দিয়েছেন, যিনি তাঁর প্রথম স্বামীর চেয়েও উত্তম, যদিও আবু সালামাও এক মহান মানুষ ছিলেন।
সূত্র: আরবনিউজ ডট কম