মানবসভ্যতার আদি প্রতিষ্ঠান হলো পরিবার। এর মাধ্যমেই সভ্যতার সূচনা ও বিকাশ। পরিবারের সূচনা বাবা আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.)–এর দাম্পত্য সম্পর্কের মাধ্যমে।
দাম্পত্য জীবনের সূচনা হয় বিয়ের মাধ্যমে। বিয়ে একটি ইবাদত। ইসলামের দৃষ্টিতে মানবজীবনের যাবতীয় কর্মকালই ইবাদত। দাম্পত্য জীবন মানবজীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যুগলবন্দী দাম্পত্য জীবনের উদ্দেশ্য হলো সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে যে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়ার উদ্রেক করেছেন। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা-৩০ রুম, আয়াত: ২১)
বিয়ের অন্যতম ফরজ অনুষঙ্গ হলো মহর। আল্লাহ তাআলা কোরআন কারিমে বলেন, ‘আর তোমরা নারীদের তাদের মহর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রদান করবে; সন্তুষ্ট চিত্তে তারা মহরের কিয়দংশ ছেড়ে দিলে তোমরা তা স্বচ্ছন্দে উপভোগ করবে।’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ৪)। মহরের পরিমাণ উভয় পক্ষের সম্মতিতে বরের সামর্থ্য ও কনের যোগ্যতা বিবেচনায় নির্ধারিত হবে। এর সর্বনিম্ন কোনো পরিমাণ নির্ধারিত নেই।
মুজতাহিদ ফকিহদের গবেষণামতে, মহরের পরিমাণ সর্বনিম্ন ১০ দিরহাম বা আড়াই ভরি রৌপ্যের সমান। মহরের সর্বোচ্চ পরিমাণ সীমিত করা নেই।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর যদি তোমরা তাদের কোনো একজনকে অগাধ সম্পদ বা অঢেল অর্থও দিয়ে থাকো, তবু তা হতে কিছুই প্রতিগ্রহণ কোরো না।’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ২০)
তবে মহরের পরিমাণ এত কম হওয়া উচিত নয়, যাতে মেয়ের সম্মান ও অধিকার ক্ষুণ্ন হয় এবং এত বেশি হওয়াও বাঞ্ছনীয় নয়, যা ছেলের ওপর জুলুম হয়। মহরের অর্থ একান্তই স্ত্রীর। এই অর্থ তিনি যেভাবে খুশি ব্যয় করতে বা সঞ্চয় রাখতে পারবেন অথবা বিনিয়োগ করবেন। তিনি যাকে ইচ্ছা দান অনুদান বা উপহার ও হাদিয়া হিসেবে দিতে পারবেন। এতে স্বামী বা অন্য কারও কোনো কিছু বলার এখতিয়ার থাকবে না।
ইসলামি বিধানমতে, কনের পক্ষ থেকে বরকে বিয়ের সময় বা তার আগে–পরে শর্ত করে বা দাবি করে অথবা প্রথা হিসেবে কোনো দ্রব্যসামগ্রী বা অর্থসম্পদ ও টাকাপয়সা নেওয়া বা দেওয়াকে যৌতুক বলে।
যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি। শরিয়তের বিধানে যৌতুক সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ এবং কবিরা গুনাহ বা মহাপাপ। মেয়ের বাড়িতে শর্ত করে আপ্যায়ন গ্রহণ করাও হারাম যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত। যৌতুক চাওয়া ভিক্ষাবৃত্তি অপেক্ষা নিন্দনীয় ও জঘন্য ঘৃণ্য অপরাধ।
বাংলাদেশ সরকারের সংবিধিবদ্ধ আইনেও যৌতুক শাস্তিযোগ্য ও দণ্ডনীয় অপরাধ। যৌতুকের শর্তে বিয়ে সম্পাদিত হলে, বিয়ে কার্যকর হয়ে যাবে; কিন্তু যৌতুকের শর্ত অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে।
ইসলামি শরিয়তের বিধানমতে, অবৈধ শর্ত পালনীয় নয় বরং বাধ্যতামূলকভাবেই তা বর্জনীয়। যে বিয়েতে যৌতুক লেনদেন হয় বা যৌতুকের শর্ত থাকে, সেসব বিয়ে বর্জন করা কর্তব্য। যৌতুকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ও সোচ্চার হওয়া আমাদের ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যাদের বিবাহের সামর্থ্য নাই, আল্লাহ তাদের নিজ অনুগ্রহে অভাবমুক্ত না করা পর্যন্ত তারা যেন সংযম অবলম্বন করে।’ (সুরা-২৪ নূর, আয়াত: ৩৩)
ইসলামি শরিয়তের বিধানাবলির অন্তর্নিহিত দর্শন বা উদ্দেশ্য তথা ‘মাকাসিদুশ শরিয়াহ’র পাঁচ পাঁচটিই বিদ্যমান রয়েছে বিয়ের মধ্যে। যথা জীবনের সুরক্ষা, সম্পদের সুরক্ষা, জ্ঞানের সুরক্ষা, বংশধারার সুরক্ষা ও ধর্মের সুরক্ষা।
তাই তো হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘বিবাহ হলো ইমানের অর্ধেক, যে বিবাহ করল, সে তার ইমানের অর্ধেক পূর্ণ করল, বাকি অর্ধেকের জন্য সে আল্লাহকে ভয় করুক।’ (সুনানে বায়হাকি, সহিহ্ আলবানী: ১৯১৬)
প্রিয় নবীজি (সা.) আরও বলেন, ‘বিবাহ করা আমার সুন্নত, যে আমার সুন্নত থেকে বিরাগভাজন হয়, সে আমার উম্মত নয়।’ (মুসলিম: ১৪০১)
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম