রাসুল (সা.)–এর প্রথম জীবনীকার মুসা ইবনে উকবা (রহ.) প্রথম জীবনে ছিলেন একজন ক্রীতদাস। তাঁর একমাত্র বিখ্যাত গ্রন্থটি রচনা করেছেন শেষ বয়সে এসে। তাঁর পুরো নাম আবু মুহাম্মাদ মুসা ইবনে উকবা ইবনে আইয়াশ আল-কুরাশি। তিনি ছিলেন বনু আসাদ ইবনে খুজাইমা গোত্রের দাস এবং সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.) (মৃ. ৭৩ হি.) বা তার পরিবারের লোকদের অধীনস্থ (আস-সিকাত, ইবনে হিব্বান, ৫/৪০৪)। তিনি মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার পর মদিনাতেই শিক্ষা লাভ করেন। মুহাম্মাদ ও ইবরাহিম নামে তার আরও দুজন ভাই থাকলেও তিনি ছিলেন সবার কনিষ্ঠ, কিন্তু ফিকহ ও হাদিসের বিদ্যায় সবার চেয়ে অগ্রসর। সুফিয়ান সাওরি (মৃ. ১৬১ হি.), সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (মৃ. ১৭৯ হি.) ও তার ভাইয়ের ছেলে ইসমাইল ইবনে ইবরাহিম ইবনে উকবা (মৃ. ১৯৬ হি.) প্রমুখ তাঁর ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম। তিনি মদিনায় ইন্তেকাল করেন, সেখানেই তাঁর দাফন হয়।
তথ্যের জন্য তিনি তাঁর গ্রন্থে সবচেয়ে বেশি সাহায্য নিয়েছেন তাঁর শিক্ষক ইবনে শিহাব জুহরি (মৃ. ১২০ হি.) রচিত আল-মাগাজি থেকে, তাঁর বইয়ের নামও দেন ঠিক একই নামে। যেমন পরবর্তীকালে ওয়াকিদি (মৃ. ৮২৩ খ্রি.) ও বিলাজুরিও (মৃ. ৮৯৮ খ্রি.) তাদের সিরাতগ্রন্থে ইবনে উকবার মাগাজি থেকে ব্যাপক তথ্য চয়ন করেছেন (সিরাতে রাসুল, আনোয়ার মাহমুদ খালিদ, ১০৯)।
দুই.
আগের মনিষীদের উক্তি থেকে বোঝা যায়, মুসা বিন উকবা রচিত এই জীবনীগ্রন্থটি কেবল সনদের সত্যতার বিচারেই অতুলনীয় নয়, বরং বর্ণনাভঙ্গির দিক থেকেও অনন্য। তিনি এমনভাবে গ্রন্থটি রচনা করেছেন, যেন পড়ে মনে হয় নবীজির (সা.) পুরো জীবন তার সামনে জ্বলজ্বল করছিল। ইমাম মালিক (রহ.) তাই ছাত্রদের বলতেন, যার কাছে ইবনে উকবার মাগাজি আছে, সে বদর যুদ্ধকে সেভাবে দেখবে, যেন তা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করছে (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৬/১১৫)। রেফারেন্স গ্রহণে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে রা. সামনে রেখেছেন, আবার কিছুক্ষেত্রে তার কাছে প্রাইমারি সোর্সও ছিল। তৎকালে বাহরাইনের শাসক মানজার ইবনে সাবির কাছে নবীজির স. প্রেরিত পত্রের কথা এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় (ফুতুহুল বুলদান, ১৩০)।
আল-মাগাজির বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যায়:
১. মুসা বিন উকবা তার গ্রন্থে প্রতিটি বক্তব্যের উৎস লিপিবদ্ধ করেছেন এবং কোনো বক্তব্য উপস্থাপন করেননি। আলফ্রেড গিওম (মৃ. ১৯৬৫ খ্রি.) পর্যন্ত (যিনি ‘সিরাতে ইবনে ইসহাকের ইংরেজি অনুবাদের জন্য খ্যাত) ইবনে উকবার প্রায় ২০টি অংশ উল্লেখ করেছেন, যার সবগুলো শক্তিশালি সূত্র দ্বারা প্রমাণিত (দ্য লাইফ অব মুহাম্মদ, ভূমিকা, আলফ্রেড গিওম)।
২. তিনি কিছু মূল লিপি পেয়েছিলেন এবং নবীজির চিঠিপত্র ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রা.) পাণ্ডুলিপির মতো মূল্যবান দলিল থেকে তথ্য আহরণ করেছিলেন।
৩. তিনি নবীজির (সা.) জীবন ও কার্যাদি সম্পর্কিত সমস্ত ঘটনা কালানুক্রমিকভাবে লিখেছেন।
৪. তিনি সর্বপ্রথম নবীজির (সা.) যে-সব সাহাবি গাজওয়াতে অংশ নিয়েছেন, তাদের একীভূত তালিকা পেশ করেছেন। এর মাধ্যমে তার প্রচুর গবেষণা ও অগাধ পাণ্ডিত্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।
তিন.
১৯৯৪ সালে প্রকাশিত মরক্কো সংস্করণ অনুসারে গ্রন্থটির মোট পৃষ্ঠা ৪২৩। ভূমিকায় সংকলক মহানবীর (সা.). জীবনী সংবলিত প্রাচীন গ্রন্থাবলির অবস্থান সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত সারগর্ভ রচনা সংযুক্ত করেছেন এবং তিনি কীভাবে এই কপির মূলপাঠ সংগ্রহ করেছেন, তারও সামান্য ধারণাও দিয়েছেন। শুরুতেই তিনি গ্রন্থ সম্পর্কে ইমাম মালিকের (রহ.) বিখ্যাত উক্তিটি সেঁটে দিয়েছেন, যা আমরা ইতিপূর্বে লিখেছি। এরপর লেখকের জীবন ও সমসাময়িকদের দৃষ্টিতে তার অবস্থান এবং তার রচিত সিরাত গ্রন্থের মর্যাদা সম্পর্কে একটি পৃথক অধ্যায় তুলে দিয়েছেন।
মূল গ্রন্থটি শুরু হয়েছে ৫৭ পৃষ্ঠা থেকে ‘আহদাসু মা কবলাল বি’সা’ বা ‘আবির্ভাবপূর্ব ঘটনাবলি’ শিরোনাম দিয়ে। তারপর সিরাত গ্রন্থের চিরাচরিত কাঠামো অনুসারে হারবুল ফিজার থেকে নিয়ে মদিনায় হিজরত পর্যন্ত ঘটনাবলি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং মদিনা অধ্যায় যাওয়ার পূর্বে দাওয়াত সংশ্লিষ্ট মক্কার বিভিন্ন গোত্রের পরিচয়ও তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয় অধ্যায়টির নাম দিয়েছেন ‘আল-আনসার’। তিনি মুহাজির ও আনসারের পরিচয় এবং মক্কার গোত্রগুলি ধরে ধরে সেখানকার মুহাজির কারা, একইভাবে মদিনার গোষ্ঠীগুলো থেকে কারা আনসারি হয়েছেন তার তালিকা পেশ করেছেন। দাওয়াত ও জিহাদ সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলিও বাদ রাখেন নি। ধারাবাহিকভাবে নবীজির তিরোধান অবধি ঘটনাক্রম সাজিয়ে এনেছেন। শেষে নবীজির পরিচালিত যুদ্ধ গুলির একটি ফিরিস্তি দিয়েছেন।
তবে গ্রন্থ এখানেই শেষ হয়ে যায়নি—৪২৩ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির ৩৩১ পৃষ্ঠা পর্যন্ত এসেছে মাত্র—বরং ওফাত পরবর্তী মদিনার উদ্ভূত ঘটনাবলি নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে এবং একটি ইতিহাসগ্রন্থের মতো আবু বকর, ওমর, ওসমান ও আলীর আমল শেষ হয়ে উমাইয়া খেলাফতে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরের রা. উত্থান পর্যন্ত চলেছে। অর্থাৎ, এটি কেবল একটি ‘জীবনীগ্রন্থে’র পরিসরে সীমিত থাকে নি—ইসলামের প্রাচীনতম ইতিহাসগ্রন্থেরও অবদান রেখেছে।
সবশেষে আধুনিক গ্রন্থাবলির মতো সারা গ্রন্থে উদ্ধৃত আয়াত, হাদিস, আসার প্রভৃতির উৎস চিহ্নিত করার জন্য এবং ভেতরে উল্লেখিত নাম, স্থান ও গোত্রের ইঙ্গিতগুলো সহজে পেতে আরবি হরফের আভিধানিক ক্রমানুসারে বিস্তারিত নির্ঘণ্ট সংযোজন করা হয়েছে; রয়েছে মরক্কোর ইবনে জুহর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য গ্রন্থপাঠের একটি সিলেবাসও।
চার.
ইতোমধ্যে পাকিস্তানের পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রন্থটির ওপর ৫ জন বিশেষজ্ঞ (ড. আতাউর রহমান, ড. জেনাস খান, ড. করিম দাদ, ড. হাফিজ মোহাম্মদ তাহির ও ড. জিয়াউল্লাহ আল আজহারি) যৌথভাবে একটি গবেষণা অভিসন্দর্ভ সম্পন্ন করেছেন, ‘মুসা ইবনে উকবা’স আল-মাগাজি: ইট’স ম্যাথোডোলজি অ্যান্ড ক্রিটিকাল অ্যানালাইসিস’ শিরোনামে। সেখানে তাঁরা এর রচনাকাল থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত গ্রন্থটির সুদীর্ঘ যাত্রাকাল, মূল্যমান ও লিখনপদ্ধতি সবিস্তারে তুলে ধরেছেন (গবেষণার সারসংক্ষেপ দেখুন: এশিয়ান জার্নাল অব সোশ্যাল সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যানিটিস: https://bit.ly/379ZwiO)।
মনযূরুল হক: আলেম ও লেখক