শারদীয় দুর্গোৎসব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। পূজা শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সম্মান প্রদর্শন, শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন বা আদর্শ অনুসরণ। 

দুর্গাপূজা প্রচলনের নানাবিধ উপাখ্যান আমরা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, দেবী ভাগবত পুরাণ, দেবীমাহাত্ম্য, রাজা সুরথের গল্প, মধু-কৈটভের কাহিনি, মহিষাসুরের কাহিনি, শুম্ভ-নিশুম্ভের কাহিনি, কালিকা পুরাণ, কৃত্তিবাসী রামায়ণ, শ্রীশ্রী চণ্ডী ইত্যাদি গ্রন্থে দেখতে পাই। 

তবে মহিষাসুরমর্দিনীরূপে শরৎকালে দেবী দুর্গার অকালবোধনই বঙ্গদেশে সুপ্রচলিত। কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ অনুসারে, রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দেবী দুর্গার আরাধনা করা হয়েছিল। 

হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন, তাই এই সময় তাঁদের আরাধনার যথাযথ সময় নয়। অসময়ের পূজা বলে এই পূজার নাম হয় অকালবোধন। 

অন্যদিকে শ্রীশ্রী চণ্ডীর কাহিনি অনুসারে, পুরাকালে মহিষাসুর শতবর্ষব্যাপী এক যুদ্ধে দেবতাদের পরাস্ত করে স্বর্গলোক অধিকার করেন। বিতাড়িত দেবগণ প্রজাপতি ব্রহ্মাকে মুখপাত্র করে মহেশ্বর ও বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হন। 

আরও পড়ুন

মহিষাসুরের অত্যাচারের কাহিনি শুনে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হন এবং তাঁদের মুখমণ্ডল থেকে মহাতেজ নির্গত হয়। একই সঙ্গে ইন্দ্র অন্য দেবতাদের দেহ থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হয় এবং সুউচ্চ হিমালয়স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই বিরাট তেজপুঞ্জ একত্র হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করে। 

এই দেবীই কাত্যায়নী বা দুর্গা নামে অভিহিত হলেন। পরবর্তী সময়ে এই দুই রূপের মিলিত ধারায় মহিষাসুরমর্দিনীরূপে শরৎকালে দেবী দুর্গার আরাধনা করা হয়। 

আবহমান বাংলার অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলো শারদীয় দুর্গোৎসব। ব্রিটিশ বাংলায় এই পূজা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। তবে অনেকের মতে, সম্ভবত মোগল আমল থেকেই ধনী পরিবারগুলোয় দুর্গাপূজা করা হতো। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দুর্গাপূজা স্বাধীনতার প্রতীকরূপে জাগ্রত হয়। 

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই পূজা ঐতিহ্যবাহী বারোয়ারি হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। অবিভক্ত ভারতের খুলনা জেলার কপোতাক্ষ তীরবর্তী উথলী গ্রামে ১০৭৬ বঙ্গাব্দে দুর্গাপূজা প্রচলনের ইতিহাস স্বর্গীয় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের বাড়ি থেকে প্রাপ্ত এক প্রাচীন নথিতে লিপিবদ্ধ আছে। 

এরই ধারাবাহিকতায় বিভক্ত বাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশেও দুর্গাপূজার বহুল প্রচলন আরম্ভ হয় বলে ধারণা করা যায়।  

আরও পড়ুন

বাংলায় দেবী দুর্গার যে মূর্তি সচরাচর দেখা যায়, সেটি পরিবার সমন্বিত বা সপরিবার দুর্গামূর্তি, যার মধ্যস্থলে মহিষাসুরমর্দিনীরূপে অবস্থান করেন দেবী দুর্গা। 

মহিষাসুর ও মহিষাসুরমর্দিনীর সংগ্রাম ও পরিশেষে মহিষাসুরমর্দিনী কর্তৃক মহিষাসুরের পরাভব মূলত মানুষের অন্তরস্থিত শুভ শক্তি ও অশুভ শক্তির সংগ্রাম এবং পরিশেষে শুভ শক্তির কাছে অশুভ শক্তির পরাজয়ের প্রতীক।

আমাদের দেশে দুর্গাপূজাকে বলা হয় শারদ উৎসব। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, উৎসবের সম্মিলনে আমরা অর্জন করি ‘আমরা’ হওয়ার বোধ-উপলব্ধি। তাই সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে দুর্গোৎসব হয়ে ওঠে সর্বজনীন শারদ উৎসব। 

এই সর্বজনীনতা সব সংকীর্ণতা ও ভেদাভেদ ভুলে আমাদের একে অপরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার শক্তি দান করে। উৎসব তাই সবার জন্যই সতত সুখের ও আনন্দের।

একইভাবে দুর্গাপূজার মতো ঈদ, বড়দিন, বুদ্ধপূর্ণিমা প্রভৃতি ধর্মীয় আচারও হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে ছাপিয়ে এসব উৎসব ঘোষণা করে মানুষে মানুষে মিলনের আহ্বান, পরস্পরের বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হয়ে ওঠার এক অমোঘ বার্তা। 

উৎসবের সঙ্গে গভীর যোগসূত্র রয়েছে শান্তির। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান ও সহমর্মিতা থেকে যে সামাজিক শান্তির পরিবেশ তৈরি হয়, তা উৎসবের আনন্দকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। 

আরও পড়ুন

কিন্তু একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মানুষ কৌশলে ধর্মীয় আচার ও উৎসবের মধ্যে বিরোধ স্থাপন করে উৎসব ও শান্তির পরিবেশকে বিঘ্নিত করার চেষ্টায় সদা নিয়োজিত থাকে। তাদের ভুললে চলবে না যে ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। 

আমাদের দেশের সংস্কৃতির অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিটি ধর্মীয় উৎসবে অন্য ধর্মের মানুষের আন্তরিক অংশগ্রহণ ও উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার প্রবণতা। যে যার মতো ধর্মচর্চা করবে, কিন্তু মনে রাখতে হবে, ধর্মসাধনার মূলমন্ত্র হচ্ছে মনুষ্যত্বের সাধনা। 

জীবনের পবিত্রতা ও অপর মানুষের সুখ–সমৃদ্ধি কামনার মধ্যেই ধর্মসাধনার সারবস্তু নিহিত। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা উচ্চারণ করি সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের মন্ত্র। 

আর ধর্মীয় উৎসব উদ্​যাপনের মাধ্যমে জাগ্রত করতে পারি মানবধর্ম ও মানবিক মূল্যবোধ। তাই অশুভ শক্তির বিনাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে মুক্তচিন্তার মানুষদের। কারণ, মুক্তবুদ্ধি দৃষ্টিভঙ্গি উদার করে, ঐক্যে বিশ্বাস করতে শেখায়। 

বিশ্বের প্রধান ধর্মগুলোর মৌলিক দর্শন এক ও অভিন্ন। অহিংসা, মৈত্রী ও সাম্যই যেকোনো ধর্মের মূল উপজীব্য। মানুষের কল্যাণসাধনই সব ধর্মের মূল শিক্ষা।

তাই আমাদের সমাজে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে হবে। জাতি–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সবার মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনকে দৃঢ় করতে হবে। নিজের ধর্মকে যেমন ভালোবাসতে হবে, তেমনি অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি থাকতে হবে অতল শ্রদ্ধা। আর এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। 

বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। এ দেশে সব ধর্মের মানুষ যেন বৈষম্যহীনভাবে ধর্ম ও ধর্মীয় উৎসব উদ্​যাপনের সুযোগ পায়। বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দুর্গাপূজার আয়োজন করলেও মূলত এই আয়োজনে আমরা জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখতে পাই। 

দুর্গাপূজা আয়োজনের সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আমরা দেখি, তা আমাদের পুলকিত করে তোলে। আয়োজনটি যেন তখন আর কোনো নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী মানুষের আয়োজন হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকে না। 

এ আয়োজন যেন বাংলাদেশের সব মানুষের সম্মিলিত আয়োজনে পরিণত হয়। দুর্গাপূজা উপলক্ষে সব ধর্মের মানুষ ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে একটি সমন্বিত আয়োজনে নিজেদের ব্রতী করে। শারদীয় দুর্গাপূজা তখন হয়ে ওঠে শারদীয় দুর্গোৎসব। এ যেন এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। 

ড. সঞ্চিতা গুহ, সহযোগী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন