দুর্গাপূজা ও জেন-জি
‘জেন-জি’ তাঁরা, যাঁদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত। এঁদের বর্তমান বয়স ১২ থেকে ২৭ বছর। এঁদের বেশির ভাগই নিয়মিত কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন
আর যাঁরা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তাঁরা শিক্ষা সমাপনের দ্বারপ্রান্তে। এঁদের ‘জেনারেশন জেড’ বা সংক্ষেপে ‘জেন-জি’ নামে অভিহিত করা হয়।
এই প্রজন্ম যৌবনের দূত। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে এই জেন-জি সদস্যরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে মার্কিন আদমশুমারি জেন-জিকে প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের সঙ্গে সর্বকনিষ্ঠ প্রজন্ম হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস ২০২১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদনে জেন-জিকে সংজ্ঞায়িত করতে ১৯৯৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারীদের চিহ্নিত করেছে।
সাধারণ মানুষ জানেন না, এমন অনেক বিষয়ে কিছু কিছু জেন–জি সদস্য চমত্কার ধারণা রাখেন, যা মূল্যায়নের দাবি রাখে। কারণ, তাঁরা ইন্টারনেটে এ–সম্পর্কিত তথ্য, তত্ত্ব ও মতামত পরীক্ষা করেছেন।
কৌতূহলও কম নয় জেন–জিদের। যেমন চলতি বছরের দুর্গাপূজা নিয়ে একজন আমার সঙ্গে আলাপ করছিলেন। তিনি বললেন, এটি কীভাবে সম্ভব? অষ্টমী ও নবমী ১১ অক্টোবর ২০২৪ শুক্রবার। আবার নবমী ও দশমী ১২ অক্টোবর ২০২৪ শনিবার।
ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পাঁচ দিন; কিন্তু এবার তা চার দিন; অর্থাৎ ৯ অক্টোবর বুধবার ষষ্ঠী দিয়ে শুরু হয়ে ১২ অক্টোবর শনিবার দশমীতে দুর্গাপূজা পঞ্জিকা অনুযায়ী শেষ, অর্থাৎ চার দিন।
রাষ্ট্রীয়ভাবে দশমী ১৩ অক্টোবর, রোববার ঘোষিত হলেও সেদিন একাদশী। একসঙ্গে এত তথ্য জানিয়ে জেন-জির এক সদস্য আমাকে কিছুটা অবাক করে দিলেন।
আমরা যারা মনে করি, জেন-জির সদস্যরা ধর্মকর্মে কিছুটা উদাসীন, তারা কিন্তু ঢালাওভাবে এই প্রজন্মকে মূল্যায়ন করি। এটি যথাযথ নয়। আমি যখন সংক্ষেপে তাঁকে বোঝালাম, তিনি শুধু শুনলেনই না, আমাকে থামিয়ে দিয়ে ফোনে নোট নিলেন।
সনাতন ধর্মের যাবতীয় অনুষ্ঠান পঞ্জিকায় বর্ণিত চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী হয়। এগুলো তিথিনির্ভর। ক্রান্তিবৃত্তের ওপর সূর্য ও চন্দ্রের পারস্পরিক দূরত্বের আনুপাতিক হারের ওপর তিথি নির্ভর করে। সূর্য ও চন্দ্রের মধ্যে যখন দূরত্ব বা স্প্যান ১৮০ ডিগ্রি হয়, তখন চন্দ্র ঠিক সূর্যের বিপরীত দিকে অবস্থান করে।
এ সময় চন্দ্র পূর্ণ আলোয় আলোকিত হয়। একে আমরা বলি পূর্ণিমা। ক্রান্তিবৃত্তের মান ৩৬০ ডিগ্রি। শুক্লপক্ষের ১৫টি তিথি (প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা) এবং কৃষ্ণপক্ষের ১৫টি তিথি (প্রতিপদ থেকে অমাবস্যা)।
৩৬০ ডিগ্রিকে ৩০টি তিথি দিয়ে ভাগ করলে প্রতি তিথি আনুমানিক ১২ ডিগ্রি পরিমাণ; কিন্তু যেহেতু পৃথিবী একটু তির্যকভাবে ঘোরে, তাই ৩৬০ দিনে বছর হয় না।
তেমনি প্রতিটি তিথির পরিমাপ বা সময় সমান হয় না; অর্থাৎ কিছুটা কমবেশি হয়। এ কারণে তিথির শুরু ও শেষ ওই পরিমাপের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়।
যেমন এ বছর বৃহস্পতিবার সপ্তমী তিথি সকাল ৭টা ৫৩ মিনিট ৫৭ সেকেন্ড পর্যন্ত। পরে অষ্টমী তিথির শুরু। শুক্রবার অষ্টমী তিথি সকাল ৭টা ১৭ মিনিট ১১ সেকেন্ড পর্যন্ত। এরপর নবমী শুরু। নবমী তিথি শনিবার ৬টা ১২ মিনিট ৫০ সেকেন্ড পর্যন্ত। এরপর দশমী তিথি শুরু। দশমী তিথির সমাপ্তি ওই দিন দিবাগত রাত ৪টা ৪৩ মিনিট ২৯ সেকেন্ড পর্যন্ত।
পরে একাদশী। ফলে রোববার; অর্থাৎ ১৩ অক্টোবর পঞ্জিকামতে একাদশী। পূজার সময়কাল নবমী ও দশমী একই দিনে; অর্থাৎ শনিবার। অষ্টমীর দিন অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে ৪৮ মিনিটব্যাপী সন্ধিপূজা অনুষ্ঠিত হয়। অষ্টমী উপলক্ষে অধিকাংশ পূজারি উপবাসব্রত পালন করেন। অষ্টমী ব্রতের উপবাস অন্তে পারণ শনিবার।
ওই জেন–জি সদস্য বিষয়টি কিছুটা জটিল আখ্যা দিয়ে এই তাড়াহুড়া বর্জন করা যায় কি না, জিজ্ঞাসা করলে আমি পঞ্জিকার বিষয় উদ্ধৃত করে তাঁকে জানাই যে এটি নির্ভুল। নির্ভুল বলেই সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের প্রকৃত সময়কাল ও দর্শনযোগ্য স্থানের যে বিবরণ পঞ্জিকায় দেওয়া হয়, তা সম্পূর্ণ সঠিক। জ্যোতির্বিদ্যা যে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান, সে কথা স্বীকারে তিনি দেরি করলেন না।
জেন–জির পরবর্তী প্রশ্ন ছিল, দান ও দক্ষিণার প্রভেদ কী? আমি ক্ষুদ্র জ্ঞানে জানালাম, দান হচ্ছে ‘বিনিময়প্রাপ্তির আশা না করে কাউকে কিছু দেওয়া।’ তিনি হেসে বললেন, পুণ্য অর্জনের ইচ্ছা অন্তত কি থাকে না?
আমি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার শ্রদ্ধাত্রয় বিভাগযোগের নিম্নোক্ত শ্লোকটি তাঁকে শোনালাম—
‘দাতব্যমিতি যদ্দানং দীয়তেহনুপকারিণে।
দেশে কালে চ পাত্রে চ তদ্দানং সাত্ত্বিকং স্মৃতম্। ২০’
‘দান করা উচিত, তাই দান করি,’ এরূপ কর্তব্যবুদ্ধিতে উপযুক্ত দেশ, কাল ও পাত্র বিবেচনা করে অনুপকারী ব্যক্তিকে (অর্থাৎ প্রত্যুপকারে আশা না রেখে) যে দান করা হয়, তাকে সাত্ত্বিক দান বলে।’
আর দক্ষিণা হলো সম্মানী বা পারিতোষিক। পুষ্পাঞ্জলি প্রদানসহ পূজামণ্ডপের আনুষঙ্গিক কাজে পুরোহিত যে শ্রমদান করেন, সে জন্য সম্মানী বা পারিতোষিক হিসেবে পূজারি তাঁকে যে অর্থ প্রদান করেন, তা–ই দক্ষিণা।
এটা শুনেই জেন-জি সদস্য বললেন, ‘বিভিন্ন কারণে অনেক পূজারি বাসা বা পূজামণ্ডপ থেকে দূরবর্তী স্থানে থেকে অঞ্জলি প্রদান অনুষ্ঠানে সম্পৃক্ত হতে পারেন, তাহলে তিনি তাঁর প্রদেয় দক্ষিণা বিকাশ, নগদ ইত্যাদি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রদান করতে যেন পারেন, তার ব্যবস্থা আপনারা করেছেন কি?’
এই প্রশ্নে আমি হার মেনে বললাম, অঞ্জলি প্রদান অনুষ্ঠানটি ‘লাইভ সম্প্রচার’ করা আপনার প্রজন্মের জন্য যেমন সহজ, দান-দক্ষিণা দেওয়ার ক্ষেত্রে পূজা কমিটির ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে যোগাযোগ করাও কঠিন না হওয়ারই কথা।
জেন-জি এরপর জানতে চাইলেন, দুর্গাপূজার দশমীতে শান্তিমন্ত্র উচ্চারণ কি বিশ্বশান্তির প্রত্যাশায় করা হয়? না পূজারিদের নিজস্ব শান্তিপ্রত্যয় দৃঢ় করার জন্য করা হয়? আমি এর উত্তর শান্তিমন্ত্রে পূর্ণ বিধৃত আছে বিধায় মন্ত্রটি তাঁর কাছে উপস্থাপন করলাম।
ওঁ কয়ানশ্চিত্র ইতস্য মহাবামদেব্যঋষির্বিরাড় গায়ত্রীচ্ছন্দ। ইন্দ্রদেবতা শান্তিকর্মণি জপে বিনিয়োগঃ। ওঁ কয়ানশ্চিত্র আভুব দূতী সদাবৃধঃ সখা। ওঁ কয়া শচিষ্ঠয়া বৃতা। ওঁ কস্তাসত্যোমদানাং মংহিষ্ঠো মত্সদন্ধসঃ। দৃঢ়াচিদারুজে বসু। ওঁ অভী ষু ণঃ সখীনাম্ অবিতা জরীতৃণাং শতং ভবাঃ স্যুতয়ে। ওঁ শান্তিঃ, ওঁ শান্তিঃ, ওঁ শান্তিঃ। ওঁ দ্যৌঃ শান্তিঃ, অন্তরীক্ষং শান্তিঃ, পৃথিবী শান্তিঃ, আপো শান্তিঃ, ওষধয়ো শান্তিঃ, বনস্পতয়ঃ শান্তিঃ, বিশ্বেদেবাঃ শান্তিঃ, ব্রহ্মং শান্তিঃ, সর্ব্বং শান্তিঃ, শান্তিরেব শান্তিঃ, ওঁ শান্তিঃ, ওঁ শান্তিঃ, ওঁ শান্তিঃ।’
বিজয়া দশমীতে তাই সনাতনীদের পক্ষ থেকে বিশ্বশান্তির আরাধনা করা হয়। কারণ, অন্যায়, অনাচার, আসুরিক কর্ম দমন করে বিশ্বজনীন শান্তিই সমৃদ্ধ মানবতার পথ উন্মুক্ত করতে পারে। উপরোক্ত মন্ত্রে তা স্পষ্ট।
ওঁ তৎ সৎ।
প্রণব চক্রবর্তী অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব ও উপদেষ্টা পুরোহিত, ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির পূজামণ্ডপ।