জন্মাষ্টমী হলো ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ জন্মতিথি। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে রোহিণী নক্ষত্রযোগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মধুরায় কংসের কারাগারে মাতা দেবকীর অষ্টম সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর এই জন্মদিনকে জন্মাষ্টমী বলা হয়। সনাতন ধর্বাবলম্বীরা দিনটিকে বিভিন্ন আনন্দ-উৎসবের মধ্যে দিয়ে পালন করে থাকেন।
ভগবদ্গীতা অনুসারে, কৃষ্ণ বা শ্রীকৃষ্ণ বিষ্ণুর অষ্টম অবতার। সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুসারে তাঁকে স্বয়ং ভগবান এবং বিষ্ণুর পূর্ণাবতারও মনে করা হয়। গীতায় বলা হয়েছে, অধর্ম ও দুর্জনের বিনাশ এবং ধর্ম ও সজ্জনের রক্ষার জন্য তিনি যুগে যুগে পৃথিবীতে আগমন করেন। কৃষ্ণের এই আগমন ঘটে কখনো মানুষ, কখনোবা মানবেতর প্রাণীর রূপে। একেই বলা হয় অবতার।
হিন্দুপুরাণ অনুসারে, আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার ২০০ বছর আগে, দ্বাপর যুগে যখন রাজা কংসের অত্যাচারে চারদিকে অরাজকতা, নৃসংশতা, নিপীড়নে মানুষ জর্জরিত, সে সময়ে বসুদেব ও দেবকীর ঘরে ভূমিষ্ঠ হন কৃষ্ণাবতার।
পৌরাণিক কাহিনিমতে, কংসের বোন দেবকীর অষ্টম সন্তানের হাতে নিজের বিনাশের দৈববাণী শুনে সে সর্বদাই আতঙ্কে থাকতেন। ফলে তিনি তাঁর বোনের গর্ভে সদ্যভূমিষ্ঠ প্রতিটি সন্তানকেই নৃশংসভাবে হত্যা করতেন। তবে গর্ভ স্থানান্তরিত করায় রোহিণীর গর্ভে জন্ম নেন দেবকীর সপ্তম সন্তান বলরাম। সবশেষে অধর্মের বিনাশ ঘটাতে জন্ম হয় কৃষ্ণের। তবে তাঁর প্রাণরক্ষার্থে ভগবান বিষ্ণুর নির্দেশ অনুসারে বসুদেব কৃষ্ণপক্ষের সেই দুর্বার প্রলয়ের রাতে সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তানকে মা যশোদার কাছে রেখে আসেন। পাশাপাশি মা যশোদার কন্যাকে নিয়ে আসেন।
এদিকে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানের ভূমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদ পেয়ে কংস ছুটে আসেন কারাগারে। তারপর যখনই সেই কন্যাসন্তানকে আছাড় মারার উদ্দেশ্যে ঊর্ধ্বে তুলে ধরলেন, তখনই সেই কন্যা মহাশূন্যে ভাসতে ভাসতে বললেন, ‘কংস, তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে!’ এই কন্যাসন্তান ছিলেন স্বয়ং দেবী যোগমায়া।
তার পর থেকেই আমাদের সমাজে যেকোনো অন্যায়কারী ও অপশাসকের উদ্দেশে বলা হয়, ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে!’ এটা আমাদের দেশের একটি জনপ্রিয় প্রবচন।
যাহোক, কৃষ্ণের সন্ধান না পাওয়ায় রাজা কংস কুখ্যাত পুতনা রাক্ষসীকে ছয় মাস বয়সী সব শিশুকে হত্যার আদেশ দেন। রাজা কংসের নির্দেশমতো রাক্ষসী পুতনা বিষাক্ত স্তন্য পান করানোর ছলে একের পর এক শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করতে থাকে। অবশেষে যখন পুতনা কৃষ্ণের সন্ধান পান এবং তাঁকে স্তন্য পান করাতে যান, তখন মাত্র ছয় মাস বয়সেই কৃষ্ণ স্তন্য পানের মাধ্যমে সব বিষ শুষে নিয়ে পুতনার প্রাণনাশ করেন।
এরপর একে একে শ্রীকৃষ্ণ কালীয় নাগ, রাজা কংসসহ জগতের নানা দুষ্টকে তাঁর অসীম লীলার মাধ্যমে নিঃশেষ করেন।
শ্রীকৃষ্ণের জন্মের সময় চারদিকে অরাজকতা, নিপীড়ন, অত্যাচার ছিল চরম পর্যায়ে। মানুষের স্বাধীনতা বলে কিছু ছিল না। সর্বত্র ছিল অশুভশক্তির বিস্তার। শ্রীকৃষ্ণ সব অশুভশক্তিকে পরাস্ত সমাজকে কলুষমুক্ত করেন।
ভগবদ্গীতায় ভগবান কৃষ্ণ মন্দের বিরুদ্ধে জয়ের প্রতীক। তিনি উল্লেখ করেছেন, যখনই পৃথিবীতে মন্দের উত্থান ঘটে এবং ধর্মের অবনতি ঘটে, তখন তিনি মন্দের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য পুনর্জন্ম লাভ করবেন এবং মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে যাবেন। জন্মাষ্টমী অশুভের ওপর শুভবুদ্ধির জয় হিসেবে পালিত হয়।