বড়দিন আমাদের যে শিক্ষা দেয়

খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বড়দিন। সে উপলক্ষে গির্জায় আলোকসজ্জা। নয়াসড়ক, সিলেট, ২৪ ডিসেম্বর। ছবি: আনিস মাহমুদ

বড়দিন মানে অনেকের কাছে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের একটি মহোৎসব। কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই বড়দিনের মহোৎসব এবং আমাদের জন্য এ ঘটনা কী শিক্ষা আনে, সেটিই হলো আমাদের প্রতিপাদ্য।

ঈশ্বরসৃষ্ট সুখী মানুষ যখন পাপ করে বসে, তখন শাস্তির পাশাপাশি ঈশ্বর মুক্তির প্রতিজ্ঞাও দিলেন। পবিত্র বাইবেলে উল্লেখ আছে, এক নারীর বংশ শয়তানের মাথা চূর্ণ করবে (আদিপুস্তক ৩: ১৫-১৬), অর্থাৎ নারী হওয়ার মধ্য দিয়ে এসেছে পাপ, ঈশ্বর-মনোনীত আরেক নারীর মাধ্যমে আসবে পরিত্রাণ। সেই নারীর গর্ভে হবে যাঁর জন্ম, তাঁর মধ্য দিয়েই পাপের অবসান হবে, আসবে মানবের পরিত্রাণ।

তাঁর আগমনে বাস্তবায়ন হবে শান্তি-সম্প্রীতি। প্রবক্তাদের মুখে শুনতে পাই: ‘সেদিন জেসে–বংশের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসবে একটি নতুন পল্লব, জেসে–বংশের সেই শিকড় থেকে জন্ম নেবে একটি নতুন অঙ্কুর। তখন নেকড়ে বাঘ মেষশাবকের সঙ্গে বাস করবে, চিতাবাঘ শুয়ে থাকবে ছাগলছানার পাশে। বাছুর আর সিংহের বাচ্চা একসঙ্গেই চরে বেড়াবে, গরু আর ভালুক তখন মিলেমিশে থাকবে, তাদের বাচ্চারাও পাশাপাশি শুয়ে থাকবে (ইসাইয়া ১১: ১-৮)।’

একটি প্রতীকী ভাষায় প্রবক্তার মুখ থেকে আমরা পাই এই শান্তির প্রতীকী চিত্র। ‘তখন এক জাতি আর অন্য জাতির বিরুদ্ধে তলোয়ার উঁচিয়ে দাঁড়াবে না, রণকৌশল আর শিখবে না কখনো (ইসাইয়া ২: ৪)।’

মোটকথা, যিশুর আগমনে পৃথিবীর মানুষের মধ্যে বাস্তবায়ন হবে শান্তি-সম্প্রীতি, ভ্রাতৃমিলন, প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা। জেসে-বংশের সেই অঙ্কুর, সেই পল্লব হলো প্রতিশ্রুত মসিহ যিশু; তাঁর আগমনে মানুষে মানুষে থাকবে শান্তি ও সম্প্রীতি; কেউই কারও ক্ষতি করবে না। যিশু দ্বারা আনীত রাজ্য হবে শান্তির রাজ্য। প্রভুর রাজ্য হবে ধর্মরাজ্য, শান্তি সেখানে থাকবে চিরকাল।

সেই প্রতিশ্রুত মসিহর প্রতীকী-উপাধিকেন্দ্রিক বিশেষণযুক্ত নাম আমরা পাই প্রবক্তা ইসাইয়ার প্রাবক্তিক বাণীতেই: ‘কেননা আমাদের জন্য একটি শিশু জন্ম নিয়েছেন, তাঁকে ডাকা হবে অনন্য পরিকল্পক, পরাক্রমী ঈশ্বর, শাশ্বত জন্মদাতা, শান্তিরাজ, এমন সব নামে (ইসাইয়া ৯: ৬)।’ ‘শোনো, যুবতী নারীটি এখন সন্তানসম্ভবা হয়ে আছে। সে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেবে। সে তার নাম রাখবে ইম্মানুয়েল—এই নামটির অর্থ “ঈশ্বর আমাদের সঙ্গেই আছেন” (ইসাইয়া ৭: ১৪)।’

আরও পড়ুন

ঘটনার পূর্ণতা

এখন থেকে ২০২৪ বছর আগে বেথলেহেমের গোশালায় ঈশ্বরের সেই প্রতিশ্রুতির পূর্ণতা নিয়ে জন্মেছিলেন সেই প্রতিশ্রুত মুক্তিদাতা, যিশুখ্রিষ্ট। সেই যিশুর জন্ম ছিল একটি ভীষণ আনন্দের বার্তা। এই বার্তা উচ্চারিত হয়েছিল সরল-সহজ এক রাখালদলের কাছে। বার্তাটি ছিল, ‘আমি তোমাদের এক আনন্দের সংবাদ জানাতে এসেছি; এই আনন্দ জাতির সব মানুষের জন্যই সঞ্চিত হয়ে আছে। আজ দাউদ-নগরীতে তোমাদের ত্রাণকর্তা জন্মেছেন—তিনি সেই খ্রিষ্ট, স্বয়ং প্রভু। এই চিহ্নে তোমরা তাঁকে চিনতে পারবে: দেখতে পাবে কাপড়ে জড়ানো, যাবপাত্রে শোয়ানো এক শিশুকে (লুক ২: ১১-১২)।’

এই যিশুর জন্মকে ঘিরেই বড়দিন উদ্‌যাপন। তাই তো প্রতিটি গির্জাঘরে, এমনকি পরিবারে ও প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় হাতে তৈরি গোশালা।

এক আনন্দের সংবাদ বলেই স্বর্গ দূতবাহিনী গেয়ে উঠেছিল: ‘জয় ঊর্ধ্বলোকে পরমেশ্বরের জয়! ইহলোকে নামুক শান্তি তাঁর অনুগৃহীত

মানবের অন্তরে!’ তাই বড়দিন, মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের মিলনের দিন, যেন মানুষ ঈশ্বরময় হয়ে ওঠে। আর মানুষ যেন মানুষের সঙ্গে শান্তি-মিলন ঘটিয়ে শান্তিময়, মিলনময় হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশে বড়দিন উৎসব

বাংলাদেশের মানুষ স্বভাবেই উৎসবপ্রিয়। আমরা বাংলাদেশিরা ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে উৎসব উদ্‌যাপন করি। বড়দিন খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। তাই বড়দিন ঘিরে উৎসবে মেতে ওঠেন বাংলাদেশি খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরা। আনন্দগানে, খাবারদাবার, অতিথি আপ্যায়ন, আশীর্বাদ দেওয়া–নেওয়ার মাধ্যমে উদ্‌যাপন করা হয় দিনটি। তবে এই বড়দিনে গির্জাঘর সাজানো হয়; তৈরি করা হয় প্রতীকী গোশালা, যেখানে শায়িত শিশু যিশুর প্রতিকৃতি। মূলত এই গোশালাই হলো কেন্দ্রীয় আকর্ষণ। কারণ, এই নবজাত যিশুকে ঘিরেই তো বড়দিনের মহোৎসব।

ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও কীর্তন

ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও কীর্তন শুরু হয় ২৪ ডিসেম্বর রাতে বড়দিনের উপাসনা বা খ্রিষ্টযোগের পর। ২৫ ডিসেম্বর দিনের বেলা আনন্দময় মহাখ্রিষ্টযোগ। রাতে ও দিনের উপাসনার পরেই শুরু হয় উল্লাসভরা আনন্দকীর্তন, যা বড়দিনের একটি বিশেষ আকর্ষণ। কীর্তনের কথাগুলো যিশুর জন্মঘটনাকে কেন্দ্র করে। প্রথমে মিশন থেকে শুরু করে এবং পরে গ্রামের বিভিন্ন পরিবারে গিয়ে কীর্তনদলটি নেচে গেয়ে কীর্তন করে।

নিমন্ত্রণ ও পারস্পরিক সাক্ষাৎ

বড়দিনে এবং বড়দিনের পর আট দিন ধরে চলে আত্মীয়দের বাড়িতে যাওয়া এবং বড়দিনের সাক্ষাৎ, আহার, শুভেচ্ছা বিনিময় ইত্যাদি।

উৎসবকেন্দ্রিক পর্যালোচনার পর এখন দেখি বড়দিনের শিক্ষা, যা সর্বজনীন:

যিশুর জন্মকে ঘিরে এই শিক্ষাবাণী:

আমাদের জন্য শিক্ষাবাণী:

  • যিশু কোনো কিছুতেই আসক্ত ছিলেন না; তিনি ঊর্ধ্ব থেকে নেমে এলেন মর্ত্যলোকে মানবসেবায়, মানব-পরিত্রাণকাজে ব্যস্ত থাকতে; ছিলেনও। আমরা যেন ভোগাবিষ্ট না হয়ে উদার হই, অন্যের প্রয়োজনের প্রতি মনোযোগী হই।

  • তাঁর জন্মের জন্য জায়গা জোটেনি। কতশত মানুষ গৃহহারা। তাদের প্রতি যেন মনোযোগী হই, বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করি।

  • জীর্ণ গোশালায় জন্ম। দারিদ্র্যকে আলিঙ্গন করলেন। অন্তরে যাঁরা দীনধন্য তাঁরা।

  • দূত রাখালদের কাছে শুভ সংবাদ নিয়ে এসেছিল; আমরা হলাম সুসংবাদবাহক। আমাদের জীবনটা যেন কথা বলে।

  • রাখাল দল সরল–সহজ, স্বচ্ছ মানুষ যিশুকে দেখতে পায়। আমরা কি সহজ–সরল মানুষ?

  • ইহলোকে নামুক শান্তি: বড়দিন—শান্তি-সম্প্রীতির দিন। বাংলাদেশে, সমগ্র পৃথিবীতে শান্তি-সম্প্রীতি ভীষণ প্রয়োজন।

  • আসুন, এই বড়দিনে বিশেষভাবে শান্তির জন্য প্রার্থনা করি। সম্প্রীতি নিয়ে পরিবারে, সংস্থায় আন্তধর্মীয় পরিসরে শান্তি-সম্প্রীতি গড়ে তুলি। হিন্দু–মুসলিম–বৌদ্ধ–খ্রিষ্টান সবার প্রতি শুভ বড়দিনের শুভেচ্ছা। শুভ বড়দিন! 

  • ফাদার প্যাট্রিক গমেজ, ক্যাথলিক ধর্মযাজক এবং নির্বাহী সচিব, জাতীয় আন্তধর্মীয় সংলাপ কমিশন

আরও পড়ুন