মদিনা মানে শহর। মদিনার পূর্বনাম ছিল ইয়াসরিব। ইয়াসরিব অর্থ অলক্ষুণে বা কুলক্ষণে। রাসুলে করিম (সা.)–এর হিজরতের পর এই ইয়াসরিবের নাম পরিবর্তন করে এর নতুন নামকরণ করা হয় ‘মদিনাতুন নবী’ বা ‘নবীর শহর’। সংক্ষেপে বলা হয় মদিনা। আরবিতে বলা হয় ‘মদিনা মুনাওয়ারা’ তথা ‘আলোক শহর’ বা আলোকিত নগরী। মদিনা দারুল হিজরাহ বা হিজরত ভূমি। মদিনায় যাওয়া, নবীজি (সা.)–এর রওজা শরিফ জিয়ারত করা হজের সপ্ত ওয়াজিবের অন্যতম।
আমাদের প্রিয় নবী (সা.) যখন দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন, তখন ‘আল আমিন’ বিশ্বাসী ও বিশ্বস্ত-খ্যাত হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর অনুসারী সাহাবাগণকে হিজরত বা স্বদেশ ত্যাগ করতে হয়। প্রথম পর্যায়ে হিজরত হয়েছিল হাবশা ও আবিসিনিয়ায়। শেষ নবুয়তের এগারোতম বছরে ছয়জন ইয়াসরিব নেতার আকাবার প্রথম বাইআতের পর পরের বছর আকাবার দ্বিতীয় বাইআতে বাহাত্তর জন ইয়াসরিববাসীর অংশগ্রহণ ও হজরত মুছআব ইবনে উমায়ের (রা.)-কে প্রথম মুআল্লিম হিসেবে প্রেরণ। পরবর্তী সময়ে আউছ ও খাজরাজ গোত্রের শত শত বছরের দ্বন্দ্ব নিরসনকল্পে স্থানীয় জনগণের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নবুয়তের তেরোতম বছরে রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করেন।
নবীজি (সা.)–এর মদিনায় ইয়াসরিবে আগমনে স্থানীয় সব ধর্মবিশ্বাসের ও সব গোত্রের সব অধিবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁকে শান্তির দূত ও অভিভাবক হিসেবে সানন্দে মেনে নেয়। ইয়াসরিবের মনস্তাত্ত্বিক অমঙ্গল দূর করতে মহানবী (সা.) প্রথমেই এর নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দিলেন ‘মদিনা’, অর্থাৎ মহানগর। এর উপাধি দেন তয়্যেবা বা তয়বা, যার অর্থ উত্তম ও পবিত্র। জনসাধারণ বলত ‘মদিনাতুর রাসুল’ বা ‘রাসুল নগর’।
নবীজি (সা.) মদিনায় যে প্রধান মসজিদটি নির্মাণ করেন, এর নাম ‘মসজিদে নববি’, যা মদিনা শরিফ নামেই পরিচিত। এই মসজিদে একাদিক্রমে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে পড়ার ফজিলত সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার মসজিদে চল্লিশ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছে আর কোনো নামাজ কাজা করেনি, সে নিফাক (মুনাফেকি) আর দোজখের আজাব থেকে নাজাত পাবে।’ (মুসনাদে আহমদ, আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব)। পবিত্র মক্কা শরিফের পরই এটি শ্রেষ্ঠ স্থান।
মক্কা শরিফ থেকে হিজরত করে যাঁরা মদিনা শরিফে গেলেন তাঁদের বলা হয় ‘মুহাজির’। মদিনাবাসী সাহাবি যাঁরা মুহাজিরদের সহায় হয়েছিলেন তাঁদের বলা হয় ‘আনসার’। মদিনা শরিফ রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর আশ্রয়ভূমি; প্রেম, ধৈর্য ও আত্মত্যাগের অনুপম স্থান এবং সত্যনিষ্ঠ ও কর্তব্যপরায়ণতার অদ্বিতীয় কর্মক্ষেত্র। মদিনাবাসীর ব্যবহার অতি মধুর, তাঁদের বাক্যালাপ অতি মিষ্ট ও তাঁদের সঙ্গ অতি পবিত্র। ইসলামে আনসার ও মুহাজিরদের বিশেষ সম্মান রয়েছে।
শান্তিধাম মদিনায় প্রিয় নবীজি (সা.)–এর কবর বা মাকবারা অবস্থিত। একে মাকবারা শরিফ বা রওজা মোবারক বলা হয়। মদিনার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থান নবীজির রওজা শরিফ। হজরত আয়িশা (রা.)-এর হুজরার মধ্যে তাঁর পবিত্র মাজার শরিফ অবস্থিত। তাঁরই পাশে হজরত আবুবকর (রা.) ও হজরত উমর (রা.)-এর মাজার। এটি বর্তমানে মসজিদে নববির অন্তর্গত।
রওজা শরিফ জিয়ারতের মাহাত্ম্য সম্পর্কে হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওফাতের পর আমার রওজা মোবারক জিয়ারত করল, সে যেন আমাকে আমার জীবদ্দশায় দর্শন করল।’ (বায়হাকি)। মদিনা মুসলমানদের প্রাণের ভূমি। মদিনা হলো নবীজির শহর, শান্তির নগর। রাসুলে করিম (সা.) বলেন, ‘যে আমার রওজা জিয়ারত করল, তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেল।’ (ইলমুল ফিকহ, আসান ফিকহ, পৃষ্ঠা ২৫০)। তিনি আরও বলেন, ‘যে হজ করল, কিন্তু আমার রওজা জিয়ারত করল না, সে আমার প্রতি জুলুম করল।’ (তিরমিজি)।
মসজিদে নববির পশ্চিম পাশের প্রবেশপথকে বাবুস সালাম বলা হয়। এই দরজা দিয়ে মসজিদে নববিতে প্রবেশ করতে হয়। মসজিদে নববির পূর্ব পাশের বহির্গমন দরজাকে বাবে জিবরাইল বলা হয়। এখানে হজরত জিবরাইল (আ.) ওহি নিয়ে এসে প্রায়ই অপেক্ষা করতেন। তাই এই নাম হয়েছে। রওজা শরিফ এবং এর থেকে পশ্চিম দিকে রাসুলে করিম (সা.)–এর মিম্বার পর্যন্ত স্থানকে রিয়াজুল জান্নাত বা বেহেশতের বাগিচা বলা হয়।
মসজিদে নববিতে রাসুলে করিম (সা.) যে স্থানে দাঁড়িয়ে নামাজের ইমামতি করতেন, সে মিহরাবকে মিহরাবুন নবী বলা হয়। এখানে হজরত জিবরাইল (আ.) যে স্থানে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছেন, তথাকার মিহরাবটি মিহরাবে জিবরাইল বা হজরত জিবরাইল (আ.)-এর মিহরাব নামে পরিচিত।
মসজিদে নববির রিয়াজুল জান্নাতে ছয়টি বিশেষ ঐতিহাসিক খুঁটি বা খাম্বা রয়েছে। স্তম্ভের আরবি হলো উস্তেয়ানা। হান্নানা অর্থ ক্রন্দসী। প্রথম দিকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি খেজুরগাছের খাম্বার সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে জুমার দিনে খুতবা দিতেন। যখন মিম্বার বানানো হলো, তখন হুজুর (সা.) মিম্বারে দাঁড়িয়ে খুতবা বয়ান করতেন। এই খাম্বা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিচ্ছেদের কারণে এমন করে কান্নাকাটি শুরু করে যে সমস্ত মসজিদের লোক স্তম্ভিত হয়ে যান। তিনি মিম্বার থেকে নেমে এসে খাম্বার গায়ে হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিলে সে শান্ত হয়। পরে সে খাম্বাটিকে দাফন করা হয়। এটির নাম উস্তেয়ানা হান্নানা বা ক্রন্দসী খুঁটি। ইতিকাফের সময় হজরত মা আয়িশা (রা.) যেই জায়গা থেকে জানালার মধ্য দিয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমত করতেন, এখানেই হজরত আয়িশা (রা.)-এর ওপর আল্লাহর রহমত ও নূর বর্ষিত হয়। এই খাম্বার নাম উস্তেয়ানা আয়িশা (রা.)। হারেস অর্থ পাহারাদার। যেখানে দাঁড়িয়ে হজরত আলী (রা.) নবীজিকে পাহারা দিতেন, সে স্থানে উস্তেয়ানা হারেস বা উস্তেয়ানায়ে আলী (রা.)। ওফুদ হলো ওয়াফদের বহুবচন, এর মানে হলো প্রতিনিধি। যেখানে বসে রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেশ-বিদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন, সেখানকার থামটির নাম উস্তেয়ানা ওফুদ। এসব স্থানে দোয়া কবুল হয়।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
[email protected]