পড়ো তোমার রবের নামে

‘পড়ো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানব আলাক হতে। পড়ো তোমার রব মহা সম্মানিত, যিনি শিখিয়েছেন কলমের মাধ্যমে। শিখিয়েছেন মানুষকে, যা তারা জানত না।’ (সুরা-৯৬ {১} আলাক, আয়াত: ১-৫)।

বিশ্বাসী মোমিনমাত্রই পাঠক

কোরআন মানে পাঠ, পঠিত, পাঠযোগ্য, পঠনীয়, পঠিতব্য। কিরাআত মানে পাঠ, আবৃত্তি, বিবৃতি। তিলাওয়াত মানে অধ্যয়ন, উপস্থাপন, পরিবেশন। কোরআন ইসলামের মূল গ্রন্থ। তাই একজন মোমিন বা বিশ্বাসীমাত্রই একজন পাঠক। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ ওহি বা প্রত্যাদেশের প্রথম শব্দ ছিল ‘পড়ো’। মহানবী (সা.) জাবালে নুরের হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন; মানবতার মুক্তি ও কল্যাণচিন্তায় বিভোর ছিলেন। এ অবস্থায় ফেরেশতাকুলের সরদার হজরত জিবরাইল (আ.) আল্লাহ তাআলার নির্দেশক্রমে এসে বললেন, ‘ইকরা—পড়ো।’ প্রিয় নবীজি (সা.) বললেন, ‘মা আনা বিকারিয়িন—আমি পাঠক নই।’ হজরত জিবরাইল (আ.) নবী (সা.)-এর সঙ্গে গভীর আলিঙ্গন করলেন এবং আবার বললেন, ‘ইকরা—পড়ো।’ নবীজি (সা.) এবারও বললেন, ‘মা আনা বিকারিয়িন—আমি
পাঠক নই।’ হজরত জিবরাইল (আ.) নবী (সা.)-এর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে আলিঙ্গন করলেন এবং পুনরায় বললেন, ‘ইকরা—পড়ো।’ নবীজি (সা.) এবার বললেন, ‘মা যা আকরাউ—কী পড়ব আমি?’ তখন হজরত জিবরাইল (আ.) একটি সবুজ রুমালে
সোনালি বর্ণে লেখা দেখিয়ে সুরা আলাক-এর উপরিউক্ত প্রথম পাঁচ আয়াত পাঠ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে হুজুরে আকরাম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামও পাঠ করলেন। (বুখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফ)।

বিশ্বশিক্ষককেও পড়তে হলো

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন বিশ্বশিক্ষক। তাঁর শিক্ষক ছিলেন স্বয়ং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। এ প্রসঙ্গে নবীজি (সা.) বলেন: ‘আমার রব আমাকে শিক্ষাদান করেছেন, তা কতই-না উত্তম! আমার রব আমাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, তা কতই-না শ্রেষ্ঠ।’ (তিরমিজি শরিফ ও মুসলিম শরিফ)। তথাপিও তাঁকে হজরত জিবরাইল (আ.) মারফত পাঠে হাতেখড়ি নিতে হয়েছে।

পাঠ শেখানোর জন্য মানব সৃষ্টি

‘রহমান-দয়াময় আল্লাহ, পাঠ শেখালেন; মানুষ সৃষ্টি করলেন, তাকে ভাষা-বয়ান শিক্ষা দিলেন।’ (সুরা-৫৫ {৯৭} আর রহমান, আয়াত: ১-৪)। এতে দেখা যায়, আগে পাঠ শেখালেন, অতঃপর মানুষ সৃষ্টি করলেন। মানুষ সৃষ্টির আগে কীভাবে তাকে পাঠ শেখালেন? মুফাসসিরগণ লিখেছেন, যদিও মানুষ সৃষ্টি করে তাকে পাঠ শেখানো হয়েছে; কিন্তু পাঠের গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য তা অগ্রে বর্ণনা করা হয়েছে। সুরা রহমানের ওই চারটি আয়াতের সরল ভাবানুবাদ করলে তা হবে, ‘দয়াময় আল্লাহ পাঠ শেখানোর নিমিত্তে মনুষ্য সৃজন করলেন।’ এতে মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য প্রকাশ পায়।

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও উন্নয়নের জন্য পাঠ

এই মর্মে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে বলা হয়েছে: ‘ইয়া ছিন! শপথ বিজ্ঞানময় কোরআনের (পঠনের)। নিশ্চয় আপনি অবশ্যই রাসুলদের অন্যতম। সঠিক পথে পরিচালিত। পরাক্রমশালী, স্নেহশীল, দয়াল আল্লাহ কর্তৃক অবতারিত।’ (সুরা-৩৬ {৪১} ইয়া ছিন, আয়াত: ১-৫)। এখানে পাঠের সঙ্গে বিষয়বস্তুর বর্ণনাও পাওয়া যায়; তা হলো প্রজ্ঞাপ্রসূত জ্ঞান ও বিজ্ঞান।

লিপি ও কলমের গুরুত্ব

পাঠ ও পড়ার জন্য লেখনী প্রয়োজন। রাসুলে আকরাম (সা.) বলেন: ‘আল্লাহ তাআলা সর্বাগ্রে কলম সৃজন করলেন এবং বললেন, লেখো! কলম বলল, কী লিখব? আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বললেন, সৃষ্টির ভাগ্য লেখো। কলম তা লিখল, কালি শুকাল, দপ্তর বন্ধ করা হলো।’ (মুসলিম শরিফ ও তিরমিজি শরিফ)। কোরআন করিমের প্রথম অবতীর্ণ সুরা ‘আলাক’-এর চতুর্থ আয়াতে কলমের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই মর্মে কোরআন মজিদের দ্বিতীয় অবতীর্ণ সুরায় বিষয়টি আল্লাহ তাআলা আরও গুরুত্বসহকারে সবিস্তারে বিবৃত করেছেন।

‘নুন! শপথ! লেখনী কলমের, আর যা তারা লিপিবদ্ধ করে তার। আপনি আপনার রবের অনুগ্রহে উন্মাদ নন। আপনার জন্য অবশ্যই রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার। আপনি অবশ্যই সুমহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত। শিগগিরই আপনি দেখবেন এবং তারাও দেখবে। তোমাদের মধ্যে কে বিকারগ্রস্ত! আপনার প্রতিপালক সম্যক অবগত আছেন, কে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং তিনি জানেন তাদিগকে, যারা সৎ পথ প্রাপ্ত। অতএব, আপনি মিথ্যাচারীদের অনুসরণ করবেন না। তারা চায় আপনি নমনীয় হন, তবে তারাও নমনীয় হবে। অনুসরণ করবেন না তার, যে কথায় কথায় শপথ করে, যে লাঞ্ছিত; পশ্চাতে নিন্দাকারী, যে পশ্চাতে পরচর্চা  করে বেড়ায়; যে কল্যাণ কাজে
বাধা দেয়, যে সীমা লঙ্ঘনকারী পাপিষ্ঠ; রূঢ় স্বভাব, তদুপরি কুখ্যাত। এ জন্যই সে অর্থ, বিত্ত ও শক্তিতে সমৃদ্ধ। তার নিকট আমার আয়াত নিদর্শন উপস্থাপিত হলে, সে বলে, এ তো সে কালের উপাখ্যান। আমি তাদের নাসিকা দাগাব।’ (সুরা-৬৮ {২} কলম, আয়াত: ১-১৬)।

সৃষ্টিতে খোদিত স্রষ্টার জ্ঞানভান্ডার

সৃষ্টির ছত্রে ছত্রে পত্রে পত্রে রয়েছে স্রষ্টার অপার মহিমা ও অনন্তকালের অফুরান জ্ঞানভান্ডার। কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের প্রয়োজনীয় সব
জ্ঞান মানুষ প্রকৃতি থেকেই আহরণ করবে। আল্লাহ তাআলা কোরআন হামিদে বলেছেন: ‘শপথ! তুর পর্বতের; শপথ! উন্মুক্ত পটে
লিখিত কিতাবের।’ (সুরা-৫২ {৭৬} তুর, আয়াত: ১-৩)।

পবিত্র কোরআন কোনো সাধারণ সাহিত্যপত্র নয়, তবে সাহিত্য মানোত্তীর্ণ। আল কোরআন কোনো সাধারণ ইতিহাসগ্রন্থ নয়,
তবে এতে রয়েছে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক দলিল-প্রমাণ। কোরআন হাকিম কোনো সাধারণ বিজ্ঞান বই নয়, তবে এতে রয়েছে বৈজ্ঞানিক তথ্য ও তত্ত্ব। কোরআন মজিদ কোনো সাধারণ ধর্মগ্রন্থ নয়, এটি সব ধর্মের সার নির্যাস। কোরআন আজিজ কোনো গল্পগ্রন্থ নয়, তবে এতে আছে প্রচুর শিক্ষণীয় সত্য কাহিনি সম্ভার। কোরআন আজিম কোনো কাব্যগ্রন্থ নয়, তবে এটি কাব্যরসে সিক্ত কালজয়ী মহাকাব্য। কোরআন করিম দুনিয়াবি কিতাব নয়, তবে দুনিয়ার সব বিষয়ের নির্দেশনা রয়েছে এতে।

ভাষাবৈচিত্র্য ও হাদিস শরিফ

ওহি বা প্রত্যাদেশ দ্বিবিধ, মাতলু ও গয়র মাতলু। মাতলু অর্থ যা তিলাওয়াত বা আবৃত্তি করা হয়। গয়র মাতলু অর্থ যা তিলওয়াত
করা হয় না। মূলত কোরআন হলো ওহি মাতলু এবং হাদিস হলো ওহি গয়র মাতলু। কোরআন নামাজে পাঠ করা হয়, এ জন্য এটি মাতলু নামে অভিহিত। হাদিস সাধারণত নামাজে পাঠ করা হয় না, তাই এটি গয়র মাতলু হিসেবে পরিচিত। কিন্তু দুটিই ওহি, অর্থাৎ আল্লাহর তরফ থেকে অবতীর্ণ। পার্থক্য হলো কোরআনের ভাব ও ভাষা উভয়ই আল্লাহর তরফ থেকে আসা আর হাদিসের ভাব আল্লাহর তরফ থেকে হলেও ভাষা নবীজি (সা.)-এর মুখনিঃসৃত। কোনো হাদিস আল্লাহর ভাব ও বর্ণনায় বিবৃত হলে তা ‘হাদিসে কুদসি’ নামে পরিচিত।

ভাষা গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। গড়ে প্রতি ১২ মাইল বা ২০ কিলোমিটার অন্তর ভাষার ধ্বনি বা উচ্চারণে তারতম্য সৃষ্টি হয়। সেহেতু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মুখনিঃসৃত বাণীও ভাব বজায় রেখে পরিবর্তিত রূপে বর্ণনা করা যায়। যাকে ‘রিওয়াইয়াত বিল মাআনা’ তথা ভাব বর্ণনা এবং ‘রিওয়াইয়াত বিল হুকুম’ অর্থাৎ বিধান বর্ণনা বলা হয়।

কোরআনের ভাষা বিচিত্রতা

সর্বশেষ আসমানি কিতাব আল কোরআন, যার হেফাজত বা সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জিম্মাদারিতে। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘নিশ্চয়ই আমিই কোরআন নাজিল করেছি এবং অবশ্যই আমিই তা সংরক্ষণ করব।’ (সুরা-১৫ {৫৪} হিজর, আয়াত: ৯)। ‘নিশ্চয় সে কোরআন সংরক্ষিত লিপিতে রয়েছে, তা পবিত্রগণ ব্যতীত কেউ স্পর্শও করতে পারে না। যা বিশ্ব প্রভুর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।’ (সুরা-৫৬ {৪৬} ওয়াকিআহ, আয়াত: ৭৭-৮০)। যা অবতারিত হয় রুহুল আমিন খ্যাত সবচেয়ে বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী ফেরেশতা হজরত জিবরাইল আমিন (আ.)-এর মাধ্যমে। ‘বরং তা সম্মানিত কোরআন; আছে সংরক্ষিত পটে।’ (সুরা-৮৫ {২৭} বুরুজ, আয়াত: ২১-২২)। দুনিয়াতে কোরআন এসেছে আল আমিন বা বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর। তদুপরি আল্লাহ পাক বলেছেন: ‘(হে রাসুল! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি দ্রুত আত্মস্থ করার জন্য জবান নাড়াতে হবে না। নিশ্চয় আমারই জিম্মা তা একত্র করা ও পাঠ করানোও। আর যখন আমি তা পাঠ করাই, তখন আপনি তার অনুসরণ করুন। (সুরা-৭৫ {৩১} কিয়ামাহ, আয়াত: ১৬-১৯)। এতত্সত্ত্বেও কোরআন করিম অন্তত সাতভাবে পড়ার অনুমোদন দিয়েছেন শরিয়ত প্রবক্তা হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)। যার প্রতিটিই বিশুদ্ধ। তিনি বলেন: ‘নিশ্চয় এই কোরআন সাত বর্ণে অবতীর্ণ; সুতরাং তোমরা পড়ো যেভাবে তোমার সহজ হয়।’ (আবু দাউদ শরিফ)। কোরআন শরিফের এই কিরাআতের বা পাঠের ভিন্নতায় অর্থে
যেমন বৈচিত্র্য আসে; তেমনি ভাবেও আসে সমৃদ্ধি এবং তাফসিরে উন্মোচিত হয় নতুন নতুন দিগন্ত।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম