২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

যেভাবে এল নৌকা, ধানের শীষ, লাঙ্গল

দরজায় কড়া নাড়ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আনুষ্ঠানিক প্রচারযুদ্ধ শুরু হলে প্রার্থীরা ছুটে যাবেন ভোটারদের দুয়ারে। ভালোবাসা, ভালো আশ্বাস আর ভালো কথায় ভোটারদের কাছে টানতে চাইবেন। কিন্তু ভোটাররা কি প্রার্থীকে দেখবেন, না দলীয় প্রতীক দেখে ব্যালট পেপারে সিল দেবেন? নাকি দুটোর হিসাবই মেলাবেন।

কোটি কোটি ভোটারের বিবেচনা যা-ই হোক না কেন, বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে ভোটের যুদ্ধ হয় মূলত আওয়ামী লীগের নৌকা, বিএনপির ধানের শীষজাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের মধ্যে। তবে এই তিন প্রতীকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেই পাকিস্তান আমল থেকে। জেনে নেওয়া যাক কীভাবে এল এসব প্রতীক।

নৌকা

আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়। শরিক হিসেবে যুক্তফ্রন্টে আরও ছিল মাওলানা আতাহার আলীর নেজামে ইসলাম পার্টি, বামপন্থী গণতন্ত্রী দলের নেতা ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ এবং মাহমুদ আলী সিলেটী। যুক্তফ্রন্ট নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রথমে ভোটের লড়াই শুরু করে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে। সেই সময় যুক্তফ্রন্টের সবচেয়ে বড় শরিক দল ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৫৪ সালের ৮ থেকে ১২ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীরা ২২৩টি আসনে বিজয়ী হন। এর মধ্যে ১৪৩টি পেয়েছিল মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ, ৪৮টি পেয়েছিল শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি। নেজামী ইসলাম পার্টি জয়ী হয় ২২টি আসনে। এ ছাড়া গণতন্ত্রী দল ১৩টি এবং খেলাফত-ই-রাব্বানী দুটি আসনে জয়ী হয়।

যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গেলে নৌকা প্রতীক পায় আওয়ামী লীগ। এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল যুক্তফ্রন্টের মধ্যে সবচেয়ে বড় দল। প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনেও আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রার্থীরা বেশি আসনে জয়ী হন।

১৯৫৭ সালে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে জন্ম নেয় আওয়ামী লীগ এবং নৌকা প্রতীকও পায় দলটি। কিন্তু নৌকায় চড়ে নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগকে অপেক্ষা করতে হয় আরও ১৩ বছর। পাকিস্তানে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ পরিষদ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করে ১৬০টি আসনে জয়ী হয়। সেই থেকে নৌকায় চড়ে নির্বাচন করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।

তবে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে নৌকার আগে লাঙ্গল প্রতীক চেয়েছিল যুক্তফ্রন্ট। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন লাঙ্গল প্রতীক যুক্তফ্রন্টকে দেয়নি। এর কারণ সম্পর্কে বিশিষ্ট সাংবাদিক তোয়াব খান বলেন, লাঙ্গল ছিল শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের অবিভক্ত ভারতের কৃষক প্রজা পার্টির। সে জন্য যুক্তফ্রন্ট পরে নৌকাকে প্রতীক হিসেবে বেছে নেয়।

কিন্তু নৌকা বেছে নেওয়ার কারণ কী? ইতিহাসবিদের কাছ থেকে জানা গেছে, নৌকা ছিল পূর্ববঙ্গের প্রতীক। বাংলায় নদীপথ ছাড়া চলাচলের উপায় ছিল না। নদীতে নৌকা মানেই পালতোলা নৌকা। নদী আর নৌকা নিয়েই গানচর্চা হতো পূর্ববঙ্গে। এই প্রতীকটা তাই ঐতিহ্যগতভাবে এই অঞ্চলের মানুষের মননে গাঁথা হয়ে গেছে।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের যাঁরা তখন ছিলেন, যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন, মাওলানা ভাসানী— তাঁরা কিন্তু গ্রামের থেকে এসেছেন। আর গ্রামীণ জীবনের অংশ তো নৌকাই। এসব কারণে হয়তো তাঁরা নৌকাকে বেছে নিয়েছেন।

ধানের শীষ

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ধানের শীষ প্রতীক ব্যবহার করা হয় ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। দেশের দ্বিতীয় এই সংসদ নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রতীক ছিল এটি। তবে ধানের শীষ প্রতীকে পাকিস্তান আমলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। পরবর্তী সময় ধানের শীষকে প্রতীক হিসেবে বেছে নেয় যুক্তফ্রন্ট থেকে বের হয়ে যাওয়া মাওলানা ভাসানীর ন্যাপ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের ন্যাপের আরেকটি অংশের প্রতীক ছিল কুঁড়েঘর। ভাসানী ন্যাপের বড় একটি অংশের যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৭৮ সালে বিএনপির জন্ম হয়। এই অংশটির নেতৃত্ব ছিলেন মশিউর রহমান যাদু মিয়া।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলবিষয়ক গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ভাসানী ন্যাপের বড় অংশ যখন মশিউর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপিতে মিশে যায়, তখন বিএনপি ধানের শীষ প্রতীক নেয়। ১৯৭৮ সালে বিএনপিতে মুসলিম লীগের শাহ আজিজও যোগ দেন। তবে যাদু মিয়ারাই বড় অংশ ছিলেন, তাঁরাই তাঁদের প্রতীক নিয়ে বিএনপিতে ঢুকে পড়লেন। জিয়াউর রহমান হয়তো তখন ধানের শীষ পছন্দ করেছিলেন।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, জিয়াউর রহমান যখন বিএনপি করলেন, তখন তাঁর মনে হয়েছে নৌকার মতো তাঁকেও একটি সর্বজনীন প্রতীক বেছে নিতে হবে। সে জন্য নৌকার মতো ধানের ছড়াকে বেছে নিলেন। তবে ধান না করে ধানের শীষ নিলেন। ধানের শীষের মধ্যে একটি পোয়েটিক ভাব থাকে।

লাঙ্গল

উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তনের ধারায় পড়েছিল লাঙ্গল। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের অবিভক্ত ভারতের কৃষক প্রজা পার্টির লাঙ্গল ধরে ফেলে আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগ। পাকিস্তানে ১৯৭০ সালে জাতীয় নির্বাচনে তাঁর দল লাঙ্গল প্রতীকে অংশ নেয়। এইচ এম এরশাদের শাসনামলে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন আতাউর রহমান খান। তাঁর কাছ থেকে লাঙ্গল প্রতীকটি জাতীয় পার্টির জন্য পছন্দ করে ফেলেন এরশাদ।

আসলে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সব দলই নিজেদের গণমানুষের দল হিসেবে পরিচিত করাতে চায়। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিও তেমনই মনে করে। এ প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনের আগে প্রতীকগুলো ওপেন ছিল। আইন ছিল আগে এলে আগে প্রতীক পাবেন। তারপরও অলিখিত নিয়ম ছিল এই দলকে ওই প্রতীক দিতে হবে। কিন্তু আইন অনুযায়ী এই প্রতীকগুলো অন্য দল চাইত, তাহলে নির্বাচন কমিশন সেটি দিতে বাধ্য থাকত। তবে বড় তিনটি দলের প্রতীকে একটি মিনিং আছে। তা হলো এরা পিপলস পার্টি, এলিট পার্টি নয়।

তাই এটা বলাই যায়, গ্রামের ভোটকে মাথায় রেখেই প্রতীক হিসেবে নৌকা, ধানের শীষ ও লাঙ্গলকে বেছে নেওয়া হয়েছে। মহিউদ্দিন আহমেদের মতে, তখনকার প্রেক্ষাপটে বেশির ভাগ ভোটার ছিলেন গ্রামীণ। গ্রামের মানুষ যেগুলোকে চেনে, ভুলে যাবে না, মনে রাখবে, যেগুলো গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে, সেগুলোকেই প্রতীক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। নৌকা, ধানের শীষ, লাঙ্গল প্রতীক তারই প্রমাণ।