১৩ অক্টোবর ২০১৮। শত শত মানুষ জমে গেছে জাতীয় প্রেসক্লাবে। তৃতীয় তলায় হলরুমটিতে সাংবাদিক আর নেতা-কর্মীদের ঠাসাঠাসি। এর মধ্যেই সরকারবিরোধী বড় জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দেয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। একাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত রাজনীতির মাঠ গরম করে রেখেছিল এ জোট। এরপর গত দুই বছরে ধীরে ধীরে অনেকটা অকার্যকর হয়ে গেছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর তেমন কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি জোট। এতে বিএনপির দায় বেশি দেখছে অন্য শরিকেরা। কারণ, জোটের মূল দল হিসেবে বিএনপি সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারেনি।
বিএনপির নেতারা বলছেন, নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সচল ছিল ঐক্যফ্রন্ট। একদিকে ২০-দলীয় জোট, আরেক দিকে ঐক্যফ্রন্ট—দুটি জোট সামলে ভোটে নেমেছিল বিএনপি। কিন্তু তাদের সব পরিকল্পনা ভোটের দিন সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের কৌশলের কাছে তছনছ হয়ে যায়। এরপর দুই জোটের নেতারা পরস্পরের ভুল খোঁজাখুঁজিতে নামেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্ট আছে। বলতে পারেন এখন এর খুব কাজ নেই। আমাদের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। সবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো, যোগাযোগও আছে।’
বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য মিলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয় গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে।
ঐক্যফ্রন্টের সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনের পর আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি তৈরি হয়। এরপর ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত ছয় সাংসদের শপথ নেওয়া নিয়ে শুরু হয় নতুন মতবিরোধ। কয়েক দফা আলোচনার পর শপথ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জোট। এরপর থেকে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের বৈঠক কমতে থাকে, থেমে যায় কর্মসূচিও। সবশেষ গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর শরিক দল নাগরিক ঐক্য নির্বাচন বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন পালন করলেও তাতে যোগ দেয়নি বিএনপি। অন্য শরিকেরা এসেছিল। এ বছর কোনো কর্মসূচি নেই এ জোটের। কোনো বৈঠকও হয়নি গত এক বছরে।
জোটের শরিক জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অকার্যকর হয়ে পড়া ও জনগণের আকাঙ্ক্ষাভিত্তিক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করা নিঃসন্দেহে হতাশাজনক। তবে ঐক্যফ্রন্ট আরও বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলে বিদ্যমান রাজনৈতিক শাসনতান্ত্রিক সংকট নিরসনে ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের লক্ষ্যে ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণ করবে বলে তাঁরা আশা করেন।
বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য মিলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয় গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে। এরপর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ যোগ দেয় এ জোটে। নির্বাচনের পর আবার জোট থেকে বেরিয়েও যায়। এর মধ্যে জেএসডি ছেড়ে আলাদা দল গঠনের পথে হাঁটেন দলটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন। এখন আবার তিনি ফিরে আসছেন বলে আলোচনা রয়েছে। এরপর শুরু হয় গণফোরামে ভাঙনের সুর। পাল্টাপাল্টি বহিষ্কারে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় গণফোরাম।
গণফোরামের দুই অংশের চারজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এরই মধ্যে বিরোধ অনেকটাই মিটে গেছে। খুব শিগগির ঐক্যবদ্ধ থাকার ঘোষণা দেওয়া হবে। এরপর দুই অংশ একত্র হয়ে জাতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নতুন নেতৃত্ব ঠিক করবে।
এর আগে, একাদশ সংসদ নির্বাচনের চার মাস পর মোস্তফা মহসীন মন্টুকে সরিয়ে রেজা কিবরিয়াকে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এটি নেতা-কর্মীদের একটা অংশ মেনে নেয়নি। ধীরে ধীরে বিরোধ বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে দুই অংশ আলাদা করে সম্মেলনেরও ঘোষণা দেয়। ড. কামালের সঙ্গে থাকা অংশ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। মোস্তফা মহসীনের অংশও এখন প্রত্যাহার করার কথা ভাবছে।
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. কামাল হোসেনের ঘোষণার মধ্য দিয়ে সব বিরোধের অবসান হয়ে যাবে। খুব শিগগির এটি দৃশ্যমান হবে।
দলটির আরেক অংশের নেতা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ বলেন, গণফোরাম যেন না ভাঙে, সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। করোনা পরিস্থিতির জন্য একটু সময় লাগছে।
তবে গণফোরামের এই নেতারা স্বীকার করেন যে ঐক্যফ্রন্টের কোনা কার্যক্রম নেই। ঐক্যফ্রন্ট যে প্রত্যাশা তৈরি করেছিল, তা ধরে রাখা যায়নি। জোটের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না প্রথম আলোকে বলেন, কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। জোটের কোনো কার্যক্রমও নেই। কিন্তু ঐক্য বা জোট থাকাটা এখনকার সময়ের জন্য খুব জরুরি ছিল।
এই জোটের সবচেয়ে বড় দল বিএনপি। জোটের শরিক দলের তিন নেতা জানান, জোট ধরে রাখলেও বিএনপি দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। আবার ভবিষ্যৎ রাজনীতির চিন্তা থেকে জোটও ভাঙছে না।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার বলেন, ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রেক্ষাপট এখনো বহাল আছে বলে তাঁরা মনে করেন। এ জোটের আঙ্গিক ও পরিসর বাড়ানোর অপেক্ষায় রয়েছেন তাঁরা। মাঝে গণফোরাম ও জেএসডির অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং করোনা মহামারি পরিস্থিতি কিছুটা সময় কেড়ে নিয়েছে। উদ্যোগ এখনো সচল আছে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, হামলা-মামলায় বিএনপির শক্তি ক্ষয় হয়ে গেছে। সরকার পরিবর্তন করতে হলে দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে রাজপথে নামতে হবে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মহল থেকে সরকারকে বাধ্য করাতে হবে। এ দুটি উপায়ের কোনোটির জন্যই সব বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং
আন্তর্জাতিক মহল পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। তবে আশা ছাড়ছে না বিএনপি। ডান ও বামের দুই জোটকে সঙ্গে নিয়েই এগোতে চান বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। তাঁরা বলছেন, সময়মতো কর্মসূচি আসবে, জোট নেতারাও সক্রিয় হবেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে এবং দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তির দাবি আদায়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল। নির্বাচনের পর পরিস্থিতি ও বাস্তবতা বদলে গেছে। এ মুহূর্তে তাই দল পুনর্গঠনে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। তবে ঐক্যফ্রন্ট ও ২০-দলীয় জোট দুটোই ঠিক আছে। প্রয়োজনে আবার জোটের রাজনীতি সক্রিয় করা হবে।