নির্বাচন কমিশন
ইসি গঠনে এবারও ছোট দলের বড় ‘সাফল্য’
২০১৭ সালের মতো এবারও নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগের নাম ছিল সরকারঘেঁষা ছোট ছোট কয়েকটি দলের তালিকায়।
তরীকত, জেপি, গণতন্ত্রী পার্টি, বাসদ-বিএসডি, এনপিপি ও বিএনএফের তালিকায় ছিল বেশির ভাগ নাম।
আ.লীগ বলছে, তাদের তালিকার কেউ নিয়োগ পাননি।
এবারও নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগের নাম ছিল সরকারঘেঁষা ছোট ছোট কয়েকটি দলের তালিকায়। এর মধ্যে তরীকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি (জেপি), গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ–বিএসডি), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) ও বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) অন্যতম। প্রথম চারটি দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের শরিক। বাকি দুটি দল সরকারঘেঁষা হিসেবে পরিচিত।
এ ছয় দলের বাইরেও নবগঠিত ইসিতে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের কারও না কারও নাম একাধিক দল বা ব্যক্তির প্রস্তাবে ছিল। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দাবি করছে, তাদের তালিকার কেউ ইসিতে নিয়োগ পাননি।
গত শনিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও চার কমিশনার নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি হয়। এ নিয়ে ১৪ দলের শরিক এবং সরকারঘেঁষা আটটি দলের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। এর মধ্যে ছয়টি দলের সূত্র জানিয়েছে, তাদের দেওয়া নামের মধ্যে এক বা একাধিক ব্যক্তি নতুন ইসিতে নিয়োগ পেয়েছেন। এর মধ্যে সিইসি ও কোনো কোনো কমিশনারের নাম একাধিক দলের তালিকায় ছিল।
১৪ দলের শরিক ও সরকারঘেঁষা দলগুলোর নেতারা বলেন, তাঁদের মনে হয়েছে যেসব নাম বেশি দলের তালিকায় এসেছে, সেগুলোই অনুসন্ধান কমিটিতে বেশি বিবেচিত হয়েছে। আগেরবারও এমনটাই করা হয়েছিল।
এবার অনুসন্ধান কমিটি তাদের কাছে জমা হওয়া ৩২২টি নামের তালিকা প্রকাশ করেছে। তবে কোন দল, কার নাম প্রস্তাব করেছে কিংবা রাষ্ট্রপতির কাছে কোন ১০ জনের নামের তালিকা পাঠানো হয়েছে, সেটা প্রকাশ করেনি। ফলে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নিজেদের জমা দেওয়া নাম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি।
এবার পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যক্তিপর্যায়েও কেউ কেউ নাম প্রস্তাব করেছেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীও অনুসন্ধান কমিটির কাছে কিছু নাম দিয়েছিলেন। পরে তিনি সেই নামগুলো সাংবাদিকদের জানান। এর মধ্যে নবনিযুক্ত সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নামও ছিল। বিকল্পধারা বাংলাদেশ পাঁচজনের নাম জমা দিয়ে তা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রকাশ করে। তবে তাদের তালিকার কেউ ইসিতে নিয়োগ পাননি।
সরকারি দল আওয়ামী লীগ অনুসন্ধান কমিটিতে তাদের দেওয়া ১০ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করেনি। তবে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল রোববার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমাদের প্রস্তাবিত নাম বাদ পড়লেও সংবিধান অনুযায়ী ইসি গঠিত হওয়ায় আমরা সন্তুষ্ট। গঠিত ইসির প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে। আওয়ামী লীগ নবগঠিত ইসিকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছে এবং সব কার্যক্রমে সার্বিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছে। এ কমিশনের অধীনে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।’
এর আগে ২০১৭ সালে গঠিত ইসিতেও সরকারঘেঁষা ছোট ছোট দলের প্রস্তাব বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। তখনো আলোচনায় এসেছিল যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছোট দলগুলোকে দিয়ে পছন্দের ব্যক্তিদের নামের প্রস্তাব করিয়েছিল। সে জন্য সিইসিসহ বিভিন্ন কমিশনারের নাম একাধিক শরিক দলের তালিকায় ছিল। এবারও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শরিকদের সঙ্গে নাম দেওয়ার বিষয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল বলে জোটের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ এ কৌশলে সাড়া দেয়নি। তবে অন্য ছোট শরিক দলগুলো নিজেদের পছন্দের নামের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিভিন্ন পক্ষ থেকে দেওয়া কিছু নামও দেয়।
এবার অনুসন্ধান কমিটিতে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ৩২২ জনের নাম জমা পড়ে। এর মধ্যে রাজনৈতিক দল থেকে আসে ১৩৬ জনের নাম। পেশাজীবী সংগঠন দেয় ৪০ এবং বিশিষ্ট নাগরিকেরা ২০ জনের নাম জমা দেন। বাকি নামগুলো ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে আসে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, তরীকত ফেডারেশন ১০ জনের নাম জমা দিয়েছিল। এর মধ্যে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল ও একজন কমিশনারের নাম ছিল। ২০১৭ সালে গঠিত ইসিতে সিইসি ও অন্য দুই কমিশনারের নাম তরীকত ফেডারেশনের তালিকায় ছিল। তখন এ কথা দলের নেতারা গর্ব করেই প্রচার করতেন। তরীকত ফেডারেশন ১৪–দলীয় জোটের শরিক।
অবশ্য তরীকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী প্রথম আলোকে বলেন, ১০টি নামের মধ্যে ইসিতে নিয়োগ পাওয়া দুজনের নাম থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাঁর দাবি, এ বিষয়ে সরকারি দলের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগসাজশ নেই।
প্রতিবার এভাবে তরীকতের তালিকা থেকে ইসিতে নিয়োগ পাওয়াটা আধ্যাত্মিক চিন্তার ফসল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি বলেন, ‘রাজনৈতিক জ্ঞান লাগে।’
২০১৪ সালের নির্বাচনে ঢাকা-১৭ (সেনানিবাস-গুলশান) আসন থেকে সাংসদ হয়ে আলোচনার জন্ম দেন এস এম আবুল কালাম আজাদ। ভোটের আগে তিনি বিএনএফ নামে একটি দল গঠন করেন এবং ত্বরিত নিবন্ধনও পেয়ে যান। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে তাঁর সখ্য থাকার আলোচনা আছে। তিনি এবার অনুসন্ধান কমিটিতে ১০ জনের নামের তালিকা দিয়েছিলেন, তাতে সিইসিসহ নতুন ইসির কয়েকজনের নাম ছিল বলে জানা গেছে। আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছেন যে নবগঠিত ইসিতে তাঁর তালিকায় থাকা নাম আছে। তবে কারা কারা আছেন, তা বলতে রাজি হননি তিনি।
জাতীয় পার্টি—জেপি ১৪–দলের শরিক। দলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ২০১৪ সালের পর সরকারের বন ও পরিবেশমন্ত্রী ছিলেন। দলটির মহাসচিব হলেন শেখ শহীদুল ইসলাম। নতুন সিইসি ও একজন কমিশনারের নাম এ দলের তালিকায় ছিল বলে জোট–সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে। তবে দলটির নেতারা এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি।
২০১৭ সালে সিইসি ও অন্য একজন কমিশনারের নাম ১৪–দলের শরিক গণতন্ত্রী পার্টির তালিকায় ছিল। এবার দলটি সাতজনের নাম জমা দিয়েছিল। এর মধ্যে একজন নতুন ইসিতে আছেন বলে জানা গেছে।
জোটের আরেক শরিক বাসদ–বিএসডির প্রস্তাব থেকে একজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ পেয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন দলটির আহ্বায়ক রেজাউর রশিদ খান। তবে তিনি ওই কমিশনারের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (এনপিপি) আটটি নাম জমা দিয়েছিল। এর মধ্যে সিইসি ও একজন কমিশনারের নাম আছে। দলটির প্যাডে জমা দেওয়া নামের তালিকার একটি কপি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে। এনপিপি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটে ছিল দীর্ঘদিন। ২০১৪ সালে দলের চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেনের (নীলু) নেতৃত্বে দলটি জোট ছাড়ে। এর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া ইফতার মাহফিলে যোগ দিয়ে জোটে আলোচনার জন্ম দেন। শওকত হোসেন ২০১৭ সালে মারা যান। তাঁর ভাই শেখ ছালাহউদ্দিন (ছেলু) এখন দলটির সভাপতি। তিনি গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের তালিকা থেকে দুজন নতুন ইসিতে স্থান পেয়েছেন বলে তিনি শুনেছেন।
১৪–দলীয় জোটসূত্র বলছে, নাম জমা দেওয়া ২৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে আটটি এ জোটের শরিক। এর বাইরে ছোট ছোট আরও কয়েকটি দল আছে, যেগুলো সরকারঘেঁষা হিসেবে পরিচিত।
১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা কারও সঙ্গে পরামর্শ করে অনুসন্ধান কমিটিতে নাম দেননি। কারা কার নাম দিয়েছে, তা অনুসন্ধান কমিটি প্রকাশ করেনি। ফলে ওয়ার্কার্স পার্টির তালিকা থেকে কেউ হয়েছে কি না, তা প্রশ্নহীন। তবে তিনি বলেন, তাঁরা রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়ে দাবি করেছিলেন যে অনুসন্ধান কমিটির চূড়ান্ত করা ১০ জনের তালিকা প্রকাশ করা হোক; নতুবা জাতীয় সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে নামগুলো নিয়ে আলোচনা হোক। কোনোটাই হয়নি। আইনের মাধ্যমে ইসি হয়েছে। এখন তারা সুষ্ঠু ও কার্যকর ভোটের জন্য কী করে, সেটাই দেখার বিষয়।