আ.লীগের ‘হেফাজত নীতি’ পছন্দ নয় জোটসঙ্গীদের
জোটের নেতারা মনে করেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে হেফাজত যেভাবে সহিংসতা চালিয়েছে, তাতে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বে ভুল বার্তা গেছে।
হেফাজতে ইসলামের বিষয়ে সরকারের নমনীয় নীতি পছন্দ নয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর। জোটের নেতারা মনে করেন, সরকার রাজনৈতিকভাবে না হলেও প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে হেফাজতের সঙ্গে একধরনের সমঝোতা করে চলেছে, যা প্রগতিশীল রাজনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। হেফাজতের সঙ্গে সরাসরি বা কৌশলগত যেকোনো ধরনের সমঝোতার বিরোধিতা অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছেন জোটের নেতারা।
১৪ দলের শরিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জোটের এই মনোভাবের কথা জানা গেছে। জোটের সূত্রগুলো বলছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে জোটের আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়নি। দিবসভিত্তিক ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভা হয়েছে। ফলে শরিকেরা নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের বাইরে জোটের অন্য শরিকেরা ব্যক্তিগত যোগাযোগে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ জোটের বাইরে নিজ দলের স্বতন্ত্র অবস্থান প্রকাশ করেছে। শরিকদের যুক্তি হচ্ছে—হেফাজতে ইসলামের প্রতিটি নেতা রাজনীতি করেন। তাঁদের রাজনীতি হচ্ছে ১৪ দলের নীতি-আদর্শের বিরুদ্ধে।
হেফাজতে ইসলাম রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে বসে আছে। কিন্তু সরকার এখনো আপস-সমঝোতার নীতিতেই আছে
সর্বশেষ গত ২৯ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ১৪ দলের ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননসহ শরিক দলের কয়েকজন নেতা হেফাজতের সাম্প্রতিক সহিংসতা ও হরতালের প্রসঙ্গ তোলেন। হেফাজতের সঙ্গে কোনোরকম সমঝোতায় না যাওয়ার পক্ষে মত দেন।
জোটের সূত্রগুলো বলছে, ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনার পর সরকার কৌশলের অংশ হিসেবে হেফাজতে ইসলামের একটা অংশের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। প্রতিষ্ঠাতা আমির আল্লামা আহমদ শফী মারা যাওয়া এবং নতুন কমিটি গঠনের পর হেফাজতের ওই অংশের নেতারা সংগঠনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারান। এখন সরকার চাইলে হেফাজতের বর্তমান নেতৃত্বের একটা অংশের সঙ্গেও যোগাযোগ তৈরি করতে পারে, কিন্তু এটা ঠিক হবে না বলে মনে করছেন ১৪ দলের নেতারা
সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন স্থানে হেফাজত যে নৈরাজ্য চালিয়েছে, সরকার তা বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। এই নৈরাজ্য কঠোর হস্তে দমন করা হবে
জোটের সূত্রগুলো বলছে, সরকারির দলের নেতারা বলছেন হেফাজতের সাম্প্রতিক সহিংসতার পেছনে বিএনপি-জামায়াত আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গীদের প্রশ্ন—সহিংসতার ঘটনায় হেফাজতের মূল নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় না কেন। এর আগে হেফাজতের দাবি মেনে সরকার সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য সরিয়েছে, যা ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে তখনো অস্বস্তি তৈরি করছিল।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, হেফাজতে ইসলাম রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে বসে আছে। কিন্তু সরকার এখনো আপস-সমঝোতার নীতিতেই আছে। সরকারের এ ধরনের কর্মকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, ১৪ দলের আদর্শের সঙ্গে যায় না। তিনি বলেন, তাঁরা ২০১৩ সালের পর থেকেই বলছেন হেফাজত সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী রাজনীতির ছাতা হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সরকার তা শোনেনি। রাজনৈতিকভাবে না হলেও রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রশাসনের মাধ্যমে সরকার হেফাজতের সঙ্গে আঁতাত করে চলেছে।
জোটের আরও একাধিক শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সব ধরনের সমঝোতা ছিন্ন করার দাবি জানান। শরিক দলের একজন নেতা ও সাংসদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের ভেতর একটা আত্মতুষ্টি কাজ করে যে হেফাজতকে কৌশলে নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের সময় হেফাজত যেভাবে সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছে, তাতে সারা বিশ্বে বার্তা গেল যে বাংলাদেশে সরকারবিরোধী মূলশক্তি হচ্ছে ইসলামপন্থী সহিংস গোষ্ঠী।
১৪ দলের শরিক জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের একটা রাজনীতি আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এর বিপরীত। আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতায়। ১৪ দল এর শরিক। ফলে ভিন্ন আদর্শের কারও সঙ্গে সমঝোতা কিংবা তাদের সঙ্গে সখ্যের কোনো সুযোগ নেই। এমনকি কৌশলগত সম্পর্কও রাখার যুক্তি নেই। এটা করলে হেফাজতেরই লাভ হবে।
২৩ দফার ভিত্তিতে ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪–দলীয় জোট গঠিত হয়। জোটের সূত্রগুলো বলছে, তখন অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা—এসব মূলভিত্তির ওপর কর্মসূচি পালিত হতো। কিন্তু পরে নির্বাচন এলেই আওয়ামী লীগ ধর্মঘেষাঁ শক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ার চেষ্টা করেছে। ২০০৬ সালে প্রথম খেলাফত মজলিশের সঙ্গে পাঁচ দফা চুক্তি করে। পরে এক-এগারোর পরিস্থিতি এবং জাতীয় নির্বাচন না হওয়ায় সেই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে আওয়ামী লীগ।
১৪ দল সূত্র জানায়, তরীকত ফেডারেশনকে ১৪ দলে অন্তর্ভুক্ত করার সময়ও শরিকদের কেউ কেউ বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও দু-একটি শরিক দল তরীকতকে জোটে নেওয়ার পক্ষে অবস্থা নেয়। পরে জাকের পার্টির সঙ্গেও সখ্য গড়ে তোলে আওয়ামী লীগ। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ নামে একটি দলকে ১৪ দলে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ।
জোটের শরিকদের বিরোধিতার কারণে তা আর এগোয়নি। তবে নির্বাচন সামনে রেখে তখন আওয়ামী লীগ ধর্মভিত্তিক অনেক দলের সঙ্গে সমঝোতা গড়ে তুলেছিল।
সরকার বিভিন্ন সময় হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা করে চলার চেষ্টা করেছে—১৪ দলের শরিকদের এমন অভিযোগ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ প্রথম আলোকে দেশ চালাতে গিয়ে কট্টর বিরোধী পক্ষের সঙ্গেও সরকারের আলোচনা করতে হয়। খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট কেক কাটার পরও তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। তবে এটাকে কোনোভাবেই আশকারা বলা যাবে না।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন স্থানে হেফাজত যে নৈরাজ্য চালিয়েছে, সরকার তা বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। এই নৈরাজ্য কঠোর হস্তে দমন করা হবে।