চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভোট কাল বুধবার। ভোট কেমন হবে, সেটাই এখন প্রধান আলোচনা। এ নিয়ে মেয়র পদপ্রার্থী কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। আওয়ামী লীগের মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনোয়ার হোসেন ও সুজন ঘোষ।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: ভোটের প্রচারের মধ্যেই সংঘাতে একজন প্রাণ হারিয়েছেন। নির্বাচনের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
রেজাউল করিম চৌধুরী: আমি তো সব দিক দিয়ে ভালো দেখছি। মেয়র ও কাউন্সিলর পদে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী। সবাই তাঁদের সমর্থকদের নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। এখন পর্যন্ত পরিবেশ খুব সুন্দর। মানুষের মধ্যে উৎসাহ–উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। ভোট সুষ্ঠু হবে।
প্রশ্ন :
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন নির্বাচনে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থকেরা কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ রাখে। বিরোধী পক্ষের লোকজন খুঁজে পাওয়া যায় না। কেউ কেউ বলছেন, এটা নিয়ন্ত্রণমূলক-একতরফা নির্বাচন।
রেজাউল করিম: দল ও প্রার্থীর জনসমর্থন থাকলে ভোটের মাঠেও লোকজন থাকবে। জনসমর্থন না থাকলে লোক কীভাবে থাকবে? বিএনপির অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে এখন তাদের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা। এ জন্যই মাঠে লোক পাচ্ছে না।
প্রশ্ন :
সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে একটা আলোচনা আছে, দলের মনোনয়ন মানেই জয় নিশ্চিত। এমন ভাবনা কি আপনার মধ্যেও আসে? আপনি কি এটা বিশ্বাস করেন?
রেজাউল করিম: আমি তা বিশ্বাস করি না। তবে অনেকে মনে করেন রাজনীতি একটা ব্যবসা। অনেকে নেতাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখে না। হঠাৎ গজিয়ে ওঠা রাজনীতিবিদদের কারণে এই প্রশ্নগুলো আসছে। তবে এখনো অনেক নেতা রাজনীতিকে আদর্শ হিসেবে নিয়ে বেঁচে আছেন। সৎ জীবনযাপন করে রাজনীতি করছেন। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আমি দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছি। আন্দোলন–সংগ্রামে জড়িত ছিলাম। আঞ্চলিক সমস্যা নিয়ে মাঠে ছিলাম। করোনায় মাঠে ছিলাম। কোনো অনৈতিক কাজে যাইনি। লোভ–লালসায় যুক্ত হয়নি। অর্থবিত্ত ও কাজের জন্য মুখাপেক্ষী হই না। আমি রাজনীতি করি একটি আদর্শকে ধারণ করে। বাকিটা ভোটাররাই বিচার করবেন।
প্রশ্ন :
এই প্রথম চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে ভোট হচ্ছে। এই নির্বাচনে নৌকা নাকি ব্যক্তি রেজাউল করিম চৌধুরী ফ্যাক্টর হবে?
রেজাউল করিম: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নৌকা প্রতীকের প্রতি মানুষের আলাদা আকর্ষণ আছে। এই নৌকাকে ভোট দিয়েই দেশ স্বাধীন হয়েছে এবং আজকে দেশের এত উন্নয়ন হচ্ছে। এরপর আসে প্রার্থীর কথা, ব্যক্তির কথা। যেমন চট্টগ্রামে আমি দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছি। ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছি।
আমি সাহস নিয়ে বলছি, আমার কোনো দুর্বলতা নেই। চট্টগ্রামের একজন লোকও যদি এসে বলেন, রেজাউল করিম চৌধুরী অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করেছেন, অন্যায় করেছেন, জুলুম করেছেন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি করেছেন, তাহলে কালকেই রাজনীতি থেকে ইস্তফা দেব।
প্রশ্ন :
পৌরসভাসহ বিভিন্ন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রকাশ্যে সিল মারার অভিযোগ এসেছে। নৌকা প্রতীকে সিল মারার জন্য প্রভাবিত করার কথা এসেছে। চট্টগ্রামে কি এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
রেজাউল করিম: এ ব্যাপারে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। চট্টগ্রামে অতীতে এ রকম হয়েছে বলেও শুনিনি।
প্রশ্ন :
বিএনপির প্রার্থীর অভিযোগ, তাঁদের নেতা-কর্মীদের হয়রানি, মামলা ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ভোটের দিন এজেন্ট দিতে পারবে কি না, এমন সংশয়ও আছে। কী বলবেন আপনি?
রেজাউল করিম: এটা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এটি সবচেয়ে লজ্জাজনক। এরা সমর্থক না পেলে এজেন্ট কোথায় থেকে দেবে? তাদের তো কেউ বাধা সৃষ্টি করছে না। হয়রানির কথা বলছেন, বিস্ফোরক মামলা, গাড়ি পোড়ানো মামলার আসামিকে পুলিশ ধরবে না? খুনের মামলার আসামিকে পুলিশ ছেড়ে দেবে? এটি নির্বাচনে টেনে আনার কী দরকার? কোনো ভালো লোক, নিরপরাধকে ধরছে কি না, সেটা দেখতে হবে।
প্রশ্ন :
চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরেই বিভক্ত। দ্বন্দ্ব কখনো ভেতরে-ভেতরে থেকেছে। প্রকাশ্যে সংঘর্ষও হয়েছে। প্রয়াত মহিউদ্দীন চৌধুরী ও আ জ ম নাছিরের অনুসারিরা দুটি পক্ষে বিভক্ত। এই ভোটে দুই পক্ষকে সমানভাবে পাশে পাচ্ছেন?
রেজাউল করিম: এখন পর্যন্ত সবাই কাজ করছে। আমি কোনো দ্বন্দ্বে বিশ্বাস করি না। আমি সংকীর্ণ দলাদলিতে নেই। নৌকা দিয়েছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আমাদের সেনাপতি। দল করলে নেত্রীর সিদ্ধান্ত মানতে হবে। কেউ সেনাপতির নির্দেশ না মানলে বিপদগামী হবেন।
প্রশ্ন :
আপনাকে কেন মানুষ ভোট দেবে?
রেজাউল করিম: আমি ১৯৬৬ সাল থেকে রাজনীতি করছি। ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ সব ধরনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। এ ছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন আঞ্চলিক সমস্যা জলাবদ্ধতা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, হোল্ডিং ট্যাক্সের সমস্যা নিয়ে আন্দোলন–সংগ্রাম করেছি। স্বাভাবিকভাবে মানুষ আমাকে কাছে পেয়েছে। মানুষের অধিকারের কথা বললে মানুষ কাছে টেনে নেবেই।
এই করোনায় চিকিৎসা, খাদ্যসংকট, সুরক্ষাসামগ্রীর সংকট দেখা দেয়। আমি হেঁটে হেঁটে বস্তি বস্তিতে গিয়ে, চট্টগ্রামের প্রতিটি ওয়ার্ডে খাদ্য ও সুরক্ষাসামগ্রী দিয়েছি। নিজ উদ্যোগে ৭০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টার করেছিলাম। প্রচার-প্রচারণার সময় এর সুফল দেখতে পেয়েছি।
প্রশ্ন :
আপনি বলেছেন যে জীবনে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করেননি। মেয়র হলে কি সেই প্রতিজ্ঞা রাখতে পারবেন?
রেজাউল করিম: যখন কলেজ–ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি, স্বাভাবিকভাবে প্রতিটি ছেলের ইচ্ছা থাকে টাকা কামাই করি। তখন যদি লোভ সংবরণ করতে পারি, তাহলে পরিণত বয়সে সেদিকে ধাবিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ৫২ বছর রাজনীতিতে অনৈতিক কাজে যাই নাই, তাহলে ভবিষ্যৎ মেয়র কিংবা আরও বড় কিছু হলেও সেদিকে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
প্রশ্ন :
মেয়র হলে ঘনিষ্ঠজনেরা সুযোগ-সুবিধা চাইতে পারেন। বিশেষ করে ঠিকাদারি কাজে দেওয়ার চাপ আসে। এ ক্ষেত্রে আপনার অবস্থান কী হবে?
রেজাউল করিম: হ্যাঁ, কেউ এমনটা সুবিধা পাওয়ার প্রত্যাশা করতে পারেন। কিন্তু দলীয় বা বাইরের লোক যে-ই হোক-কোনো অন্যায়-অনৈতিক কাজ কেউ আমাকে দিয়ে করাতে পারবে না।
প্রশ্ন :
কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী অনেক। ইতিমধ্যে সহিংসতায় একজন খুন হয়েছেন। ভোটে কি এর প্রভাব পড়বে?
রেজাউল করিম: কাউন্সিলর নিয়ে প্রতিযোগিতা হবে। কিন্তু মেয়র প্রার্থীর ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না।
প্রশ্ন :
আপনি দীর্ঘদিন রাজনীতিতে আছেন। কিন্তু প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা নেই। এত বড় নগরীর মেয়রের পদ কীভাবে সামলাবেন?
রেজাউল করিম: অভিজ্ঞতা নিয়ে কেউ জন্মগ্রহণ করেন না। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হয়। নিজের উদ্যোগ থাকলে অভিজ্ঞতা আপনা–আপনি এসে যায়। উন্নয়ন, ভালো কাজের জন্য জ্ঞানী-গুণী, পরিকল্পনাবিদ, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কাজ করব।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
রেজাউল করিম: আপনাদেরও ধন্যবাদ।