‘নিস্তেজ’ হয়ে পড়া আন্দোলনে গতি আনার পথ খুঁজছে বিএনপি
নেতা-কর্মীদের অনেকে আশা করছেন, মহাসচিবসহ কারাবন্দী নেতারা শিগগিরই মুক্তি পাবেন। আবার আন্দোলনের নতুন যাত্রা শুরু হবে।
‘নিস্তেজ’ হয়ে পড়া সরকারবিরোধী আন্দোলন আবার চাঙা করার পরিকল্পনা করছে বিএনপি। তবে নতুন করে কীভাবে আন্দোলনের শুরু হবে, সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এখন দলের নীতিনির্ধারণী নেতারা আন্দোলনের কর্মকৌশল নিয়ে ভাবছেন। একই সঙ্গে তাঁরা রাজনৈতিক মিত্রদের সঙ্গেও কথা বলছেন।
আড়াই মাস পর বিএনপির নেতা-কর্মীরা গত বৃহস্পতিবার তালা ভেঙে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢোকেন। গতকাল শুক্রবার কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের সেভাবে দেখা যায়নি। তবে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা গতকাল কার্যালয়ে বসেছেন, সংবাদ সম্মেলন করেছেন। জেলা কার্যালয়গুলোও খোলা শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নয়টি মামলায় জামিন পেয়েছেন। তবে তাঁর বিরুদ্ধে আরও মামলা রয়েছে।
নেতা-কর্মীদের অনেকে আশা করছেন, মহাসচিবসহ কারাবন্দী নেতারা শিগগিরই মুক্তি পাবেন। আবার আন্দোলনের নতুন যাত্রা শুরু হবে।
বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ভোট বর্জনের মধ্যেই ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ‘কম ভোটার উপস্থিতির’ এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে ১১ জানুয়ারি আবার সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের দিন ১১ জানুয়ারিকে ‘কালো দিন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী। তিনি গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এক-এগারোর (২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার) কৃষ্ণতম দিনে ডামি ভোটে আরেকটি কৃষ্ণতম মেকি সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। ডামি ভোটে নির্বাচিত অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি আন্দোলন চালিয়ে যাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের বিরুদ্ধে আবার সভা-সমাবেশসহ গণসংযোগমূলক কর্মসূচি শুরুর চিন্তা করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে বিএনপি ভোট বর্জনের জন্য দেশবাসীকে ‘অভিনন্দন’ জানিয়ে সারা দেশে প্রচারপত্র বিতরণ করছে। ভোটের পর দুই দিনের এই কর্মসূচি শেষ হলেও অঘোষিতভাবে প্রচারপত্র বিতরণ চলছে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
নেতা-কর্মীদের অনেকে আশা করছেন, মহাসচিবসহ কারাবন্দী নেতারা শিগগিরই মুক্তি পাবেন। আবার আন্দোলনের নতুন যাত্রা শুরু হবে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, অসংখ্য নেতা-কর্মী মামলার আসামি হয়ে ফেরারি জীবনযাপন করছেন। প্রায় ২৭ হাজার নেতা-কর্মী কারাবন্দী। এখন তাঁদের জামিনে মুক্ত করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে কর্মী-সমর্থকদের ধীরে ধীরে কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়াতে হবে।
রুহুল কবির রিজভী গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির নেতা-কর্মীদের নিরুৎসাহিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা জনগণকে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়েছিলাম। জনগণ ভোট দিতে যায়নি। গণতান্ত্রিক বিশ্বে এই সরকারের কোনো স্বীকৃতি নেই। বিএনপি আন্দোলনে আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত অবৈধ সরকারের পতন না হচ্ছে, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার না হচ্ছে, আন্দোলন চলবে।’
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক দলগুলোর একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা বিএনপিকে শক্ত প্রস্তুতি নিয়ে কর্মসূচি সাজানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি, সরকারের অনাচার, দুর্নীতি, ভোটের নামে বারবার তামাশায় চরম অতিষ্ঠ। পুলিশ, প্রশাসনসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের একপক্ষীয় অবস্থানে ক্ষুব্ধ। এ ছাড়া বিরোধী দলের লাখ লাখ নেতা-কর্মী মামলায় জর্জরিত। এখন তাঁদের বিচারে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া শুরু হয়েছে। এই সরকারের অবসান না হলে কারোরই অস্তিত্ব থাকবে না।
গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ভোট বর্জন করে জনগণ তাদের বার্তা দিয়ে দিয়েছে। এখন দেশের সম্ভাবনা বাঁচিয়ে রাখার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে মরিয়া হয়ে লড়াই করতে হবে। হাল ছেড়ে দিলে সবার ভবিষ্যৎ শেষ।
বিএনপির নেতা-কর্মীদের নিরুৎসাহিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা জনগণকে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়েছিলাম। জনগণ ভোট দিতে যায়নি। গণতান্ত্রিক বিশ্বে এই সরকারের কোনো স্বীকৃতি নেই। বিএনপি আন্দোলনে আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত অবৈধ সরকারের পতন না হচ্ছে, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার না হচ্ছে, আন্দোলন চলবে।রুহুল কবির রিজভী
গতকাল নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়
তালা ভেঙে কার্যালয়ে ঢোকার দ্বিতীয় দিন গতকাল বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা কার্যালয়ে আসেন। বেশির ভাগ নেতা-কর্মীর আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বিএনপির আন্দোলন ও নির্বাচন। অধিকাংশই মনে করেন, ভোটাররা নির্বাচনে ভোট দিতে যাননি, এটাই বিএনপির বড় অর্জন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, মানুষ ভোট দিতে না গেলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে, এটাই বাস্তবতা। তবে আওয়ামী লীগের সমালোচনার পাশাপাশি অনেককে আত্মসমালোচনা করতেও দেখা যায়। তাঁরা আন্দোলন-কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের অংশগ্রহণ না থাকায় সমালোচনা করেন।
পল্টন থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আল আমিনের সঙ্গে গতকাল কথা হয় নয়াপল্টনের কার্যালয়ে। তাঁর মতে, আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার দায় জ্যেষ্ঠ নেতাদের। কারণ, তাঁরা কর্মসূচি ঘোষণার পর আর কোনো ভূমিকা রাখেননি। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার কারণে অনেকের মন ভেঙে গেছে। তবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
নয়াপল্টনের কার্যালয়ে এসেছিলেন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার ৯ নম্বর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আনোয়ার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া বিএনপির আর কিছু করার নেই। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভদ্র আন্দোলন করে লাভ নেই। তাদের সঙ্গে তাদের মতো আন্দোলন করতে হবে।