ছাত্রদলের কমিটি: কারও ছাত্রত্ব শেষ এক যুগ আগে, কারও অর্ধযুগ আগে
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ২৫৭ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটির সিংহভাগই নিয়মিত শিক্ষার্থী নন। এই নেতাদের বেশির ভাগ স্নাতকে ভর্তি হয়েছিলেন এক যুগের বেশি সময় আগে। সেই হিসাবে তাঁদের নিয়মিত স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার কথা অন্তত অর্ধযুগ আগে। বয়সে বেশির ভাগই ত্রিশোর্ধ্ব। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই কমিটিতে থাকা প্রায় শতভাগ নেতাই পড়াশোনায় অনিয়মিত।
ঈদুল আজহার দুই দিন আগে ১৫ জুন ঘোষিত ছাত্রদলের এই কমিটিকে ‘আংশিক পূর্ণাঙ্গ’ কমিটি বলা হচ্ছে। বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের এই কমিটিতে পরবর্তী সময়ে আরও কিছু নেতা–কর্মীকে যুক্ত করা হবে বলে এমন নামকরণ।
এর আগে ১ মার্চ ছাত্রদলের সাত সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। সেখানে রাকিবুল ইসলামকে সভাপতি ও নাছির উদ্দীনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। কমিটিতে আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়াকে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, শ্যামল মালুমকে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আমানউল্লাহ আমানকে সাংগঠনিক সম্পাদক, মো. জাহাঙ্গীর আলমকে দপ্তর সম্পাদক এবং শরিফ প্রধান শুভকে প্রচার সম্পাদক করা হয়।
সেই আংশিক কমিটিই সম্প্রসারণ করে ‘আংশিক পূর্ণাঙ্গ’ করা হয় ১৫ জুন। ২৬০টি ক্রম থাকলেও কমিটিতে তিনটি পদ ফাঁকা রয়েছে। অর্থাৎ মূলত ২৫৭ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। আগের সাত নেতার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের কমিটিতে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ২৫০টি নাম।
ছাত্রত্ব নেই বেশির ভাগের
ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে। সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে। জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবু আফসান ২০০৬-০৭, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শ্যামল ২০০৭-০৮, সাংগঠনিক সম্পাদক আমানউল্লাহ আমান ২০০৯-১০, জাহাঙ্গীর আলম ২০০৭-০৮ এবং শরিফ প্রধান ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন।
অর্থাৎ ১৪ থেকে ১৭ বছর আগে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন৷ সাধারণ হিসাব ধরলেও তাঁদের বয়স অন্তত ৩১ থেকে ৩৪ বছর হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কোর্সের শিক্ষার্থী হিসেবে এক বা দুই বছর বিরতি দেওয়ার পরও সর্বোচ্চ আট বছরে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করা যায়। সেই সময়সীমা ধরলেও ৬ থেকে ৯ বছর আগে তাঁদের নিয়মিত ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার কথা। কমিটিতে পদ পাওয়া অন্যদের অবস্থাও কমবেশি এই সাত জ্যেষ্ঠ নেতার মতোই।
২১ জন নারী ছাত্রদলের এই ‘আংশিক পূর্ণাঙ্গ’ কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন। ২৫৭ সদস্যের কমিটির ৮৭ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ছাত্রদলের সূত্রগুলো জানিয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষ আর অন্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষ ধরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়েছে। তবে নারীদের ক্ষেত্রে বয়সসীমার বিষয়টি শিথিল ছিল।
অর্থাৎ যাঁরা কমিটিতে পদ পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে কনিষ্ঠ, তাঁরাও স্নাতকে ভর্তি হয়েছেন প্রায় এক যুগ আগে। অনেকেরই এখন আর অনিয়মিত ছাত্রত্বও নেই। অর্থাৎ এখন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিও নেই। কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়মিত কোর্সে ভর্তি আছেন। নারীদের মধ্যেও কেউ কেউ অনিয়মিত কিংবা ‘ড্রপ আউট’ (শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়া) শিক্ষার্থী। মোটাদাগে ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটির পদগুলোর প্রায় শতভাগই পড়াশোনায় অনিয়মিতদের দখলে।
ছাত্রদলের নেতাদের বয়স বেশি হওয়ার কারণে প্রায়ই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছাত্রলীগ তাদের সমালোচনা করে থাকে। তবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও কয়েকজন বয়স্ক নেতা আছেন। নেতাদের বয়স এত বেশি হওয়ার বিষয়ে ছাত্রদলের তিনজন নেতার সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ছাত্রদলকে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগ ঢুকতে দিচ্ছে না। ফলে নতুন কর্মী সংগ্রহের সুযোগ কম। পাশাপাশি ছাত্রদলের সঙ্গে যুক্ত হলে হামলা-মামলাসহ নানা হয়রানির ভয়ও আছে। বাস্তব কারণেই ছাত্রদলের নেতাদের বয়স বেশি।
এ বিষয়ে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পর্যন্ত আসতে সংগঠনের অনেক স্তর পার হয়ে আসতে হয়। এ ক্ষেত্রে সময়সীমাটা একটু বেড়ে যায়। এটি শুধু ছাত্রদল নয়, অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের ক্ষেত্রেও একই রকম হয়ে থাকে।
কমিটি নিয়ে সমালোচনা
বয়সে জ্যেষ্ঠ হওয়ায় ছাত্রদলের দুজন নেতা ঘোষিত কমিটিতে কোনো পদ পাননি। তাঁদের একজন প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রদলে বিভিন্ন বলয় রয়েছে। সাধারণত বলয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়ে থাকে। বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্দিষ্ট দুটি বলয় থেকে নেতা হয়েছেন। তাই তাঁরা অন্য বলয়গুলোর অনুসারীদের কমিটিতে অবমূল্যায়ন করেছেন। অনেককে কমিটিতে রাখাই হয়নি।
অন্যজন কমিটিতে প্রত্যাশিত পদ পাননি। তাঁর দাবি, তিনি বয়সে জ্যেষ্ঠ। তাঁর নাম কমিটিতে ওপরের দিকে থাকার কথা ছিল। কিন্তু রাখা হয়েছে কনিষ্ঠদের নিচে। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রেই এ রকম হয়েছে। এ ছাড়া রাজপথে সক্রিয় থেকেও কমিটিতে ৪৫-৫৫ জনের জায়গাই হয়নি।
ব্যাংক কর্মকর্তা, যুবদল নেতাও কমিটিতে
ছাত্রদলের অন্তত পাঁচজন নেতার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ছাত্রদলের কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ পাওয়া হাসনাইন নাহিয়ান ওরফে সজীব কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া একটি সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। সহসাধারণ সম্পাদক মির্জা মারুফ একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুর রহমান ওরফে তাজ একজন ঠিকাদার। দুজন নেতার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। তবে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে নিশ্চিত তথ্য না পাওয়ায় তাঁদের নাম উল্লেখ করা হলো না।
এসব সমালোচনা ও অভিযোগের জবাবে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন বলেন, কমিটি করার ক্ষেত্রে গত বছরের ২৮ অক্টোবর থেকে গত ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচন পর্যন্ত রাজপথে বিভিন্ন কর্মসূচিতে কার সক্রিয়তা কেমন ছিল, তা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। কমিটিতে এখনো কিছু পদ ফাঁকা আছে। এসব পদে যোগ্যতা ও সক্রিয়তা অনুযায়ী পদায়ন করা হবে। কমিটির দু-একজনের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু আমরা পরে তাঁদের সনদ যাচাই করে দেখেছি। তবু কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে।
কমিটি করেছে বিএনপি
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত খসড়া গঠনতন্ত্র দিয়েই চলছে ছাত্রদল। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ওই খসড়াটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। ২০১৯ সালের শেষ দিকে গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত তা চূড়ান্ত করতে পারেনি ছাত্রদল। ফলে ছাত্রদলের কমিটির আকার, কমিটি গঠন-পুনর্গঠন ও পদায়নের মানদণ্ডের মতো বিষয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রীতি অনুযায়ীই করা হচ্ছে। এখানে গুরুত্ব পাচ্ছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের ইচ্ছা ও পছন্দ।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিবন্ধিত হতে চাইলে তাদের গঠনতন্ত্র থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক অথবা ছাত্র অথবা আর্থিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী অথবা শ্রমিক অথবা পেশাজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন থাকার বিধান বিলুপ্ত করতে হবে। অর্থাৎ নিবন্ধিত দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছাত্রসংগঠন থাকা বেআইনি।
কিন্তু ছাত্রদলকে বিএনপি কার্যত নিজেদের সহযোগী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। ছাত্রদলও নিজেদের বিএনপির সহযোগী সংগঠন মনে করে। ছাত্রদলের কমিটি গঠন ও ভেঙে দেওয়া থেকে শুরু করে প্রায় সবই নিয়ন্ত্রণ করছে বিএনপি। এমনকি কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটিও বিএনপির দপ্তর থেকে ঘোষণা করা হয়। ১৫ জুন ছাত্রদলের ২৫৭ সদস্যের যে ‘আংশিক পূর্ণাঙ্গ’ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে ছাত্রদলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের কোনো স্বাক্ষর ছিল না, ছিল বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর।
তবে এতে আইনের কোনো ব্যত্যয় দেখছেন না ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ছাত্রদলের সাংগঠনিক অভিভাবক৷ তাঁর মাধ্যমে নির্দেশিত হয়ে বিএনপির দপ্তর থেকে ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করা হয়ে থাকে।