কোটাব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে কী ভাবছে সরকার
কোটাব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিলের অবস্থানে না থেকে এটি সংস্কারের কথা ভাবছে সরকার। এ ব্যাপারে প্রস্তুতিও নিচ্ছে তারা। কোটা বহাল থাকার সময় ও বাতিলের পরে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের হার পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদনও তৈরি করা হয়েছে। সরকারের একাধিক মন্ত্রী জানিয়েছেন, একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব তৈরির বিষয়ে আলোচনা রয়েছে।
যদিও সরকার–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কোটাব্যবস্থা পর্যালোচনা করছে। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে সরকার রাজনৈতিক বা নির্বাহী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের পথে হাঁটবে না।
এখন পুরোপুরি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং পরামর্শ মেনে কোটা সংস্কারের বিষয়টি সম্পন্ন করবে। ফলে আদালতের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করবে সরকার।
তবে এরপরও আন্দোলন চালিয়ে গেলে সরকারের কিছুটা কঠোর অবস্থানে যাওয়া উচিত, এমন চিন্তাও রয়েছে সরকারের ভেতরে।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আদালত বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত দেবেন বলে আশা করেন তিনি।
অন্যদিকে কোটা নিয়ে উচ্চতর আদালতের সর্বশেষ গতকালের আদেশের পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেমে যাওয়া উচিত বলে মনে করছে সরকার। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ একাধিক মন্ত্রী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন। তবে এরপরও আন্দোলন চালিয়ে গেলে সরকারের কিছুটা কঠোর অবস্থানে যাওয়া উচিত, এমন চিন্তাও রয়েছে সরকারের ভেতরে।
কারণ, সরকারের দিক থেকে শিক্ষার্থীদের অবরোধ কর্মসূচির কারণে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের বিষয় সামনে আনা হচ্ছে। তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আপিল বিভাগের আদেশের কারণে কোটা বাতিলের সরকারের পরিপত্র বহাল থাকছে। আদালতের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী সরকার পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। সে কারণে জনদুর্ভোগ তৈরি করে, শিক্ষার্থীদের এমন কর্মসূচি পরিহার করা উচিত।
শিক্ষার্থীদেরও সরকারের আন্তরিকতার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া দরকার। পাশাপাশি জনদুর্ভোগের বিষয়টিও মাথায় নিতে হবে। ফলে আর কোনো সড়ক বা রেলপথ অবরোধ করে কর্মসূচি নেওয়া হবে না—এমনটাই প্রত্যাশা সরকারের।
সরকারের পর্যালোচনা
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত কোটাপদ্ধতি নিয়ে এর আগে আন্দোলনের মুখে ওই ব্যবস্থা সরকার বাতিল করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর। এরপর কোটাবিহীন ৪০তম, ৪১তম ও ৪৩তম বিসিএসের মাধ্যমে এবং তার আগে পাঁচ দফায় কোটাভিত্তিক নিয়োগের হার পর্যালোচনা করে সরকার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে দেখা যায়, কোটাবিহীন নিয়োগে অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া কোটা বাতিলের পর অনুষ্ঠিত একটি বিসিএসে নারীদের নিয়োগের হার কোটা থাকার সময়ের চেয়ে কমেছে। কোটাবিহীন নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার থেকে নিয়োগের হারও কমেছে। আর জেলাভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। কোনো কোনো জেলায় নিয়োগের হার অনেক কম। এই পর্যালোচনা প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা আলোচনা করছেন বলে সরকারি সূত্রগুলো বলছে।
কঠোর হওয়ার চিন্তা
গতকাল বুধবার উচ্চ আদালতের আদেশের পরও বিকেল পর্যন্ত রাস্তায় অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছিলেন শিক্ষার্থীরা। এতে রাজধানী ঢাকা দিনভর অচল থাকে। বিভিন্ন স্থানে রেল ও মহাসড়কে অবরোধের কারণে সারা দেশের যোগাযোগব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়ে। ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ।
সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কোটাবিরোধী আন্দোলনটিকে যৌক্তিক এবং স্পর্শকতার হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে কোনো ধরনের বাধা দেয়নি সরকার। এমনকি শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে সব ধরনের আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বের ত্রুটি করেনি। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদেরও সরকারের আন্তরিকতার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া দরকার। পাশাপাশি জনদুর্ভোগের বিষয়টিও মাথায় নিতে হবে। ফলে আর কোনো সড়ক বা রেলপথ অবরোধ করে কর্মসূচি নেওয়া হবে না—এমনটাই প্রত্যাশা সরকারের।
এখন শিক্ষার্থী ও সরকার উভয়েরই সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান করা প্রয়োজন।সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান
সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরুর পর থেকেই সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্কতা এবং ধৈর্য ধরে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। গতকাল সন্ধ্যার পরও একই নির্দেশনা বহাল ছিল। তবে গতকাল রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর শেষে দেশে ফিরেছেন। আজ নতুন কোনো নির্দেশনা এলে সেভাবেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরুর পর সরকারের করণীয় নিয়ে তৎপর এমন একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, কোটা আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের অংশ নেওয়ার বিষয়টি শুরুতে পুরোটাই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। এরপর ধীরে ধীরে এতে রাজনৈতিক উপাদান যুক্ত হয়েছে। পেছন থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে উচ্চ আদালতের রায়ের পরও কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া হলে মনে করতে হবে, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের ভেতরে কঠোর হওয়ার ব্যাপারেও আলোচনা রয়েছে।
তবে সরকার কোটা সংস্কারের চিন্তার কথা বললেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। কারণ, সরকার আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষার কথাই বলছে। তবে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান মনে করেন, কোটা সংস্কারের বিষয়টি প্রশাসনিক। ফলে সমাধানের দায়িত্ব সরকারের বলে তিনি মনে করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন শিক্ষার্থী ও সরকার উভয়েরই সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান করা প্রয়োজন।