সংসদে নেই, এলাকায়ও নেই সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ
সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফকে গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারির পর আর ফরিদপুরে দেখা যায়নি। বর্তমানে তিনি সুইজারল্যান্ডে আছেন।
স্থানীয় রাজনীতি থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় সংসদের কাজেও নিষ্ক্রিয় ফরিদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। সাবেক এই মন্ত্রী এখন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। আট মাস ধরে এই কমিটিরও কোনো বৈঠক হচ্ছে না।
জাতীয় সংসদের শেষ তিনটি অধিবেশনে অনুপস্থিত ছিলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। একসময় ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির এই নিয়ন্ত্রককে গত আড়াই বছরে নির্বাচনী এলাকায় দেখা গেছে মোটে দুবার। তাঁর এই নিষ্ক্রিয়তায় সংসদীয় কমিটি যেমন অচল হয়ে পড়েছে, তেমনি নির্বাচনী এলাকার কিছু উন্নয়নকাজেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ফরিদপুর-৩ আসন থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ২০০৯ সালে তিনি প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী হন। এরপর ফরিদপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তাঁর অনুগতরা বিভিন্ন সরকারি সংস্থার উন্নয়নকাজের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি ও জমি দখল করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন।
কেন দীর্ঘদিন ধরে কমিটির বৈঠক হচ্ছে না, তা তিনি জানেন না। সভাপতি দেশে না থাকায় বৈঠক হচ্ছে না, এমনটাও হতে পারে।মসিউর রহমান, জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য
তাঁরা যাকে খুশি তুলে এনে মারধর ও লাঞ্ছিত করতেন। এই কাজে নেতৃত্ব দিতেন সাজ্জাদ হোসেন ওরফে বরকত ও তাঁর ভাই ইমতিয়াজ হাসান ওরফে রুবেল। তাঁরা সেখানে দুটি বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। আলোচিত এই দুই ভাই রাজনীতিতে এসেছিলেন মোশাররফ হোসেন ও তাঁর ভাই মোহতেশাম হোসেনের (বাবর) হাত ধরে।
২০২০ সালের ১৬ মে ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবলচন্দ্র সাহার বাড়িতে হামলার ঘটনায় করা একটি মামলার সূত্র ধরে ওই বছরের ৭ জুন রাতে পুলিশের বিশেষ অভিযানে খন্দকার মোশাররফের অনুসারী এবং আলোচিত দুই ভাই বরকত-রুবেল গ্রেপ্তার হন।
এরপরই মূলত স্থানীয় রাজনীতি থেকে নির্বাসিত হন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। গত ৮ মার্চ অর্থ পাচার মামলায় মোশাররফের ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর কিছুদিন পর থেকে জাতীয় সংসদের কাজেও পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন একসময়ের আলোচিত মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। গত এপ্রিলের শেষ দিকে তিনি সুইজারল্যান্ডে চলে যান।
সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি চলতি বছর কেবল দুটি বৈঠক করে। সর্বশেষ বৈঠক হয়েছিল গত ১৩ মার্চ। এরপর আর কোনো বৈঠক হয়নি। জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে প্রতি মাসে অন্তত একটি করে বৈঠক করার কথা বলা আছে। সেখানে গত আট মাস কোনো বৈঠক করেনি এই কমিটি।
‘আমাকে মোশাররফপন্থী বলা হয়। তবে যারা তাঁর পন্থী ছিল, তারা তো সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাঁর (মোশাররফ) ওখানে গিয়ে পানি খায় নাই এমন লোক নাই।’আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা, বর্তমানে উপজেলা পরিষদের সভাপতি
সংসদীয় কমিটির কাজ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো কোনো বিল বা বিষয় পরীক্ষা করা এবং কমিটির আওতাধীন মন্ত্রণালয়ের কাজ পর্যালোচনা, মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম, অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করা। এ ছাড়া কমিটি উপযুক্ত মনে করলে তাদের আওতাধীন যেকোনো বিষয় সম্পর্কে পরীক্ষা করতে এবং সুপারিশ করতে পারে।
কমিটির বৈঠক ডাকার এখতিয়ার সভাপতির। কার্যপ্রণালি বিধিতে বলা আছে, সভাপতি যেরূপ নির্ধারণ করে দেবেন, অনুরূপ দিবস ও সময়ে কমিটির বৈঠক বসবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সভাপতি দীর্ঘদিন দেশে না থাকায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির কোনো বৈঠক হচ্ছে না। কোনো কারণে বিধি অনুযায়ী কমিটির বৈঠক ডাকা না হলে স্পিকার সংসদ সচিবালয়ের সচিবকে কমিটির বৈঠক আহ্বানের নির্দেশ দিতে পারেন। তবে সাধারণত এই চর্চা দেখা যায় না।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মসিউর রহমান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কেন দীর্ঘদিন ধরে কমিটির বৈঠক হচ্ছে না, তা তিনি জানেন না। সভাপতি দেশে না থাকায় বৈঠক হচ্ছে না, এমনটাও হতে পারে। তিনি বলেন, কমিটির অনেক কাজ থাকে। বৈঠক না হলে কিছু সমস্যা তো হয়। কমিটির বৈঠক যাতে ডাকা হয়, সে জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।
সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, খন্দকার মোশাররফ হোসেন সর্বশেষ জাতীয় সংসদের বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন গত ৬ এপ্রিল। সেটি ছিল একাদশ জাতীয় সংসদের ১৭তম অধিবেশন। এরপর বাজেট অধিবেশনসহ তিনটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর কোনোটিতেই উপস্থিত ছিলেন না খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি টানা ৩১ কার্যদিবস জাতীয় সংসদের অধিবেশনে অনুপস্থিত।
২০১৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি এরপর স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য হন। তবে এবার তাঁকে কোনো মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়নি। তাঁকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি করা হয়।
২০২০ সালের ৭ জুন ফরিদপুরে খন্দকার মোশররফের বাড়িতে বিশেষ অভিযান চালিয়ে তাঁর দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগী ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে বরকত ও তাঁর ভাই ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান ওরফে রুবেলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর দুই দিন পর ৯ জুন খন্দকার মোশাররফ ঢাকায় চলে যান। ওই বছরের ১৪ জুলাই এক রাতের জন্য ফরিদপুর গিয়েছিলেন। এরপর তাঁর চাচির জানাজায় অংশ নিতে আরেকবার ফরিদপুর যান ২০২১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। তারপর থেকে তাঁকে আর নিজের নির্বাচনী এলাকায় দেখা যায়নি। এলাকার রাজনীতিতেও এখন আর তাঁর অবস্থান নেই। তাঁর সহযোগীরা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের সঙ্গে রাজনীতি করছেন।
ফরিদপুরে মোশাররফপন্থী হিসেবে পরিচিত ফরিদপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমানে উপজেলা পরিষদের সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে মোশাররফপন্থী বলা হয়। তবে যারা তাঁর পন্থী ছিল, তারা তো সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাঁর (মোশাররফ) ওখানে গিয়ে পানি খায় নাই এমন লোক নাই।’
একসময় ফরিদপুরের রাজনীতিতে প্রতাপশালী মোশাররফের ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন, তাঁর অনুগত বরকত ও রুবেল এবং ব্যক্তিগত সহকারী এ এইচ এম ফোয়াদ এখন অর্থ পাচার মামলায় কারাগারে আছেন। ২০২০ সালে বরকত ও রুবেলকে গ্রেপ্তারের পর ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য মজিবর রহমান ওরফে নিক্সন চৌধুরী এলাকায় বিভিন্ন সমাবেশে বক্তব্যে বলেছেন, খন্দকার মোশাররফ ছিলেন একটা দানব। ২০২০ সালের ৭ জুন পুলিশের অভিযানে দানবের পতন হয়েছে।
এলাকায়, রাজনীতিতে বা সংসদে কোথাও কেন নেই—এ নিয়ে খন্দকার মোশাররফের সঙ্গে সম্প্রতি টেলিফোনে প্রথম আলোর কথা হয়। তিনি বলেন, তিনি এখন জেনেভায় মেয়ের কাছে আছেন। ডায়াবেটিক ও ব্লাডপ্রেশারের চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসা শেষ করে দেশে ফিরবেন। তিনি দাবি করেন, তিনি বিদেশে বসেই তাঁর কর্তব্য করে যাচ্ছেন।
আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন কি না, জানতে চাইলে খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘আমার এই ৮৫ বছর বয়সে আর লাথিগুঁতা খাইতে ইচ্ছা করছে না। রাজনীতির সুস্থ পরিবেশ নেই ফরিদপুরে। আমি সামনে নির্বাচন করব না। তবে সবার সাথে একসাথে থাকতে চাই। আমার কবরও আমি বান্ধায় রাখছি। তোমরা যদি থাকতে দাও, তাহলে থাকব ফরিদপুরে, না হলে থাকলাম না, ঢাকায় থাকলাম। তবে আমারে খেদাই দেওয়ার মতো শক্তি কি কারও আছে?’
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, তাঁর ভাই ও তাঁদের সহযোগীদের পতনে ফরিদপুরের রাজনীতিতে একধরনের স্বস্তি এসেছে। কিন্তু সংসদ সদস্যের নিষ্ক্রিয়তার কারণে কিছু সমস্যাও হচ্ছে। ফরিদপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, জনপ্রতিনিধি না থাকায় সব কাজে স্থবিরতা নেমে এসেছে।
টেপাখোলা লেক প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। সংসদ সদস্যের জন্য বিশেষ বরাদ্দ জেলা পরিষদ ও এলজিইডিতে পড়ে আছে। খরচ হচ্ছে না। সংসদ সদস্য সক্রিয় না থাকলে কাজ গতিশীল হয় না।