দুর্নীতির প্রসার ঘটিয়ে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান অবাস্তব: সংসদে জি এম কাদের
জবাবদিহির ঘাটতি ও সুশাসনের অভাবকে অর্থনৈতিক সংকটের কারণ বলে মনে করেন বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদের। তিনি বলেছেন, অর্থনীতিতে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের প্রসার ঘটিয়ে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান চিন্তা করা অবাস্তব। অর্থনীতিকে সুস্থ করতে হলে সমাজের সর্বস্থরে জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকতে হবে।
আজ শনিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে জি এম কাদের এ কথা বলেন।
জি এম কাদের আরও বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দায়মুক্তি দিয়ে আইন প্রণয়ন করে দেশে অবাধ দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি, অফশোর ব্যাংকিং চালু করে বিদেশে পাচার করা অবৈধ অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। নামমাত্র করের বিনিময়ে কালোটাকা সাদা করার মাধ্যমে দুর্নীতি থেকে দায়মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী, ব্যাংক ঋণখেলাপি, বিদেশে টাকা পাচারকারীদের মাধ্যমে একটি বড় আকারের ধনী ও অতি ধনী শ্রেণি সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের অর্থনীতির মূল স্রোতে আনার জন্য বিভিন্ন সুযোগ–সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে।
জি এম কাদের বলেন, কোভিড মহামারি ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। বিভিন্ন দেশ আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু দেশের অর্থনীতিতে ক্রমাবনতি ঠেকানো যাচ্ছে না। সে কারণে অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা, কোভিড মহামারি বা ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশে মূল সমস্যাগুলো সৃষ্টি করেনি। সমস্যা শুরু হয়েছিল আগেই অন্যান্য কারণে। কোভিড মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধ এগুলোকে উসকে দিয়েছিল মাত্র।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, অর্থনীতিতে সুশাসনের অভাব, সে কারণে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নে যে ব্যাপকতা, তা থেকে উত্তরণ ছাড়া অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। বাজেটে মূল সমস্যার কোনো স্বীকৃতি ও সে সমস্যা মোকাবিলার দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়নি, বরং সমস্যার কারণগুলোকে উৎসাহিত করার প্রায়ই লক্ষ করা যায়। কাজেই বিদ্যমান অর্থনৈতিক সমস্যার টেকসই ও স্থায়ী সমাধান খুব শিগগির হচ্ছে, এমনটা আশা করা যাচ্ছে না।
ব্যাংক খাতে অব্যবস্থাপনার সমালোচনা করে জি এম কাদের বলেন, তথ্য গোপন করে ব্যাংক খাতকে নাজুক পরিস্থিতিতে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংক খাত নড়বড়ে। কারণ হলো খেলাপি ঋণ।
অফশোর ব্যাংকিং আইনের সমালোচনা করে জি এম কাদের বলেন, অফশোর ব্যাংকিং আইনের মাধ্যমে বড় ধরনের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এ কথা খুব ব্যাপকভাবে প্রচলিত যে দেশের কিছু ব্যবসায়ী বিভিন্নভাবে টাকা উপার্জন করেন ও ঋণখেলাপি হয়ে ধনী ও অতি ধনী হয়েছেন, তাঁরা সে অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। তাঁদের সেসব অর্থকে বৈধতা দেওয়া ও ব্যবহার করে মুনাফা করার সুযোগ দেওয়ার জন্যই এ আইন করা হয়েছে। সে হিসাবে এ আইনটিতে দায়মুক্তি দেওয়া অর্থনৈতিক ও দুর্বৃত্তায়ন সহায়ক বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে নতুন করে বৈধ–অবৈধভাবে অর্জিত টাকা বিদেশে পাচার উৎসাহিত হতে পারে।
কালোটাকা সাদা করার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে জি এম কাদের বলেন, অনেকেই বলেছেন এটা সংবিধানসম্মত নয়, নীতিসম্মত নয়, আয়ও বেশি আসবে না। যদি এই সুযোগ দিতেই হয়, তাহলে ১৫ শতাংশ নয়, ৫০–৬০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি।
বিদ্যুৎ খাতের সমালোচনা করে জি এম কাদের বলেন, উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানো হলেও এখন প্রায় লোডশেডিং হচ্ছে। অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা দেশের অর্থনীতিতে একটি মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ শোধ করতে হয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎসংক্রান্ত আইনের সমালোচনা করে জি এম কাদের বলেন, দায়মুক্তির এই আইন জনস্বার্থের পক্ষে কোনো ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি। বরং দুর্নীতির বিস্তার ঘাটিয়ে অর্থনীতিকে বেসামাল করে তোলা হয়েছে।
জি এম কাদের বলেন, আইএমএফ বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্চ দেওয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের সুপারিশ দেয়নি। যাতে করে এটা বিশ্বাস করার কারণ আছে, আইএমএফ তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ তাদের দেওয়া ঋণ সুদসহ ফিরিয়ে নিতে বেশি আগ্রহী। দেশের জনগণের স্বার্থে সুপারিশ করছে না।
রিজার্ভের সঠিক পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকে গ্রহণযোগ্যভাবে তুলে ধরার আহ্বান জানিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদের বলেন, সংবাদ মাধ্যমে রিজার্ভের যে পারিমাণের কথা আসে, মানুষ সেটাই বিশ্বাস করে। বাংলাদেশ ব্যাংককে বিশ্বাস করে না।
প্রস্তাবিত বাজেটকে গতানুগতিক বাজেট উল্লেখ করে জি এম কাদের বলেন, এবার উন্নয়ন বাজেট কমানো উচিত ছিল। খাদ্যে, কৃষিতে ভর্তুকি, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ আগের চেয়ে কমানো হয়েছে। অবকাঠামোগত ও যোগাযোগ উন্নয়ন খাতে বাড়ানো হয়েছে বেশি। সাধারণ মানুষের জন্য রেশনের দোকান চালু করার প্রস্তাব দেন জি এম কাদের।