বিএনপি আন্দোলনে থাকবে, তবে এখনই বড় কর্মসূচি নয়

বড় কর্মসূচি দিলে সরকার মামলা-হামলা বাড়াবে বলে আশঙ্কা দলটির। তাই এখনই নয়, নির্বাচনের কাছাকাছি গিয়ে বড় আন্দোলনের চিন্তা।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য সরকারই দায়ী বলে মনে করে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, খাদ্য ও জ্বালানির দাম নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে সংকট, তার সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সংকটের মিল নেই। দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে ক্ষমতাসীনদের সীমাহীন দুর্নীতি এবং বিদেশে অর্থ পাচারের কারণে।

বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, গুম, খুনসহ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সোচ্চার থাকবে বিএনপি। তবে দলটি এখনই হরতাল বা অবরোধের মতো বড় কর্মসূচিতে যাবে না।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং দলের দুই নেতা হত্যার প্রতিবাদে গতকাল সোমবার দুই দিনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে। এর মধ্যে ১১ আগস্ট ঢাকার নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এবং ১২ আগস্ট দেশের সব মহানগর ও জেলায় প্রতিবাদ সমাবেশ হবে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

বাংলাদেশে বর্তমানে যে বিদ্যুৎ–সংকট, জ্বালানিসংকট, অর্থনৈতিক সংকট—সব সংকটের মূলে সরকারের চরম দুর্নীতি।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

বিএনপির নেতারা বলছেন, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর খাদ্যপণ্য নিয়ে যে বৈশ্বিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা মোকাবিলা করা যেত, যদি সরকারের সে দক্ষতা থাকত। কিন্তু তারা উন্নয়নের নামে একদিকে বড় বড় প্রকল্প নিয়েছে এবং পদে পদে সেসব প্রকল্পের ব্যয় অস্বাভাবিক বাড়িয়ে সেখান থেকে লুটপাট করেছে। নেতাদের অভিযোগ, শুধু বিদ্যুতের ‘কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট’ থেকেই ৭৮ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে।

বিএনপির নেতারা সভা-সমাবেশে যে বক্তব্য দিচ্ছেন, তার মূলে থাকছে সরকারের দুর্নীতি। গতকাল ঢাকায় এক সমাবেশেও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের বিরুদ্ধে ‘অর্থ পাচারসংক্রান্ত’ একটি নথি প্রদর্শন করেন। তিনি বলেন, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে ২৭০ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকে হিসাব আছে ২৩৯ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলারের। বাকি ৩০ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার কোথায় গেল। বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এটা একটা বিরাট ডাকাতি, বিরাট লুটের একটা চিত্র।’

অন্যদিকে বর্তমানে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিজনিত সংকটও সরকারের সৃষ্ট বলে মনে করে বিএনপি। নেতাদের যুক্তি হলো, বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সরকার কেন্দ্র বাড়িয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে জ্বালানির প্রয়োজন হয়, তার জোগান দিতে সরকার দেশীয় ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলনে একেবারেই উদাসীন ছিল। সরকার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতেই বেশি উৎসাহ দেখিয়েছে। কাজটি করা হয়েছে সরকারের ঘনিষ্ঠদের ব্যবসা দিতে। এখন যার খেসারত দিচ্ছে দেশের মানুষ। এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বর্তমানে বৈশ্বিক যে সমস্যা, এটা হ্যান্ডেল (সামাল দেওয়া) করা যেত। বাংলাদেশের সমস্যা ভিন্ন। বাংলাদেশে বর্তমানে যে বিদ্যুৎ–সংকট, জ্বালানিসংকট, অর্থনৈতিক সংকট—সব সংকটের মূলে সরকারের চরম দুর্নীতি।’

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, সরকার প্রথম থেকেই উন্নয়নের মাধ্যমে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির প্রচারের দিকেই মনোযোগী।

উন্নয়ন, জাতীয় প্রবৃদ্ধির বিষয়ে নানা রকম বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছে। বৈশ্বিক আধুনিক সরবরাহব্যবস্থায় ডলারের দাম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব বিষয়ে বহু আগে থেকেই বিশেষজ্ঞরা সরকারকে সতর্ক করেছে। কিন্তু সরকার সতর্ক হয়নি। বরং বিদ্যুতের লোডশেডিং ও জ্বালানি খাতের অব্যবস্থাপনার মতো সাধারণ কর্মসূচিতেও গুলি চালিয়ে দমন করার চেষ্টা করছে।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণমাধ্যমেই খবর এসেছে যে গত ১২ বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার লুটপাট হয়েছে এবং বিদেশে নিয়ে গেছে। এখন রিজার্ভের টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে, সেটা জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সরকার বাঁচার চেষ্টা করছে।’

সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার থাকলেও এখনই বড় কর্মসূচিতে যেতে বিএনপি কেন রাজি নয়, সে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন দলটির নেতারা। তারা বলছেন, নির্বাচনের বাকি আরও দেড় বছর।

এখনই বড় কর্মসূচি দিয়ে তারা সরকারের সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে চান না। বড় কর্মসূচি দিলে সংঘাত হবে এবং সরকার মামলা-হামলা আরও বাড়াবে। তার চেয়ে নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত রেখে নির্বাচনের কাছাকাছি গিয়ে বড় আন্দোলন গড়তে চাইছে দলটি।

অবশ্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপির কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। ভোলায় গুলি করে মেরেছে, সোমবার শাহবাগে বাম ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের নির্মমভাবে পিটিয়েছে। এভাবে সরকার আন্দোলন দমন করতে চায়। কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হবে না।