জুলাই অভ্যুত্থানের অগ্নিঝরা দিনগুলো উঠে এসেছিল আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে থাকা তরুণদের স্মৃতিচারণায়। আন্দোলনে শহীদ, আহত ব্যক্তিদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সমবেদনা ছিল তাঁদের কণ্ঠে। আর ছিল দেশে আবার যেন কোনো স্বৈরতন্ত্র ফিরে না আসে, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করার প্রত্যয় ও প্রত্যাশা।
গতকাল শনিবার বিকেলে এই স্মৃতিচারণার সুযোগ ঘটে জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু নামে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বইয়ের আনুষ্ঠানিক প্রকাশনা অনুষ্ঠানে। বইটি লেখা হয়েছে জুলাইয়ে স্বৈরাচার উৎখাত করা গণ-আন্দোলন নিয়ে। লিখেছেন সেই গণ–আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক, বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বেলা তিনটায় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল প্রথমা প্রকাশন।
অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ছিলেন বইটির লেখক আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। আলোচনায় অংশ নিয়েছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও যুগ্ম সদস্যসচিব রিফাত রশিদ।
রাষ্ট্রকে গণ-অভ্যুত্থানের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে নিতে হবে। সেই চেষ্টায় কাজ চালিয়ে যেতে আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার বইটি উদ্বুদ্ধ করবে।আসিফ নজরুল, আইন উপদেষ্টা, অন্তর্বর্তী সরকার
অনুষ্ঠানে জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী তরুণ প্রজন্মের নেতা-কর্মীরা ছাড়াও ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের রেল, সড়ক ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, বিশেষ সহকারী মনির হায়দার, গণফোরাম নেতা সুব্রত চৌধুরীসহ দেশের সাহিত্য–সংস্কৃতি অঙ্গনের তরুণ ও বিশিষ্টজনেরা। অনুষ্ঠানে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিদের বিপুল সমাগম ছিল উৎসাহব্যঞ্জক।
প্রথমা প্রকাশনের প্রধান সমন্বয়কারী মশিউল আলম অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। তিনি বলেন, প্রথমা প্রকাশন জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে এর আগে আরও পাঁচটি বই প্রকাশ করেছে। এই বইয়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, লেখক নিজেই জুলাই অভ্যুত্থানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিলেন। ঘটনার ভেতর থেকে অভ্যুত্থানের বিষয়গুলো তিনি যেভাবে দেখেছেন, তা তুলে ধরেছেন। ভারসাম্য বজায় রেখে সাহসিকতার সঙ্গে তিনি অভ্যুত্থানের পর্যায়গুলোর বিবরণ দিয়েছেন। ভবিষ্যতে জুলাই অভ্যুত্থানের ইতিহাস রচনা ও গবেষণায় এই বই আকরগ্রন্থ হিসেবে ভূমিকা রাখবে।
আসিফ নজরুল বইটি সম্পর্ক বলেন, লেখা খুব সাবলীল। গল্পের মতো করে ঘটনার পরম্পরা তুলে ধরা হয়েছে। ঘটনাগুলো অভিভূত হওয়ার মতো। জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র, পুলিশ, সাধারণ মানুষ মিলিয়ে এত চরিত্র, এত ঘটনা রয়েছে যে সবার ভূমিকা মনে রাখা কঠিন। সবকিছুর বর্ণনা দেওয়াও কঠিন। বইটিতে সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
জুলাই অভ্যুত্থান কেবল আত্মদানের বেদনার গল্প নয়, গণমানুষের বিজয় ও সাহসের গল্প। যে অভূতপূর্ব ঐক্য ও সম্মিলিত প্রত্যাশার প্রকাশ এই আন্দোলনে দেখা গেছে, তাকে এগিয়ে নিতে হবে মন্তব্য করে আসিফ নজরুল বলেন, রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। একাত্তরের পর আবারও একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই সুযোগ নষ্ট করা চলবে না। রাষ্ট্রকে গণ-অভ্যুত্থানের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে নিতে হবে। সেই চেষ্টায় কাজ চালিয়ে যেতে আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার বইটি উদ্বুদ্ধ করবে।
নাহিদ ইসলাম গণ-অভ্যুত্থানের দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করে বলেন, এই আন্দোলন পরিকল্পিত এবং স্বতঃস্ফূর্ত—দুভাবেই এগিয়েছে। প্রথমে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। সেখানে তাঁরা ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছেন। বিশেষ করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সড়ক অবরোধের প্রক্রিয়াটি তাঁরা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রয়োগ করে পুলিশ ও সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফলভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন।
নাহিদ ইসলাম বলেন, তাঁরা প্রথম থেকেই চেষ্টা করেছেন এই আন্দোলনে যেন কোনো রাজনৈতিক পরিচিতি না থাকে। তবে রাজনৈতিক দল বা ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মীরা অংশ নিতে চাইলে তাঁদের বাধাও দেওয়া হয়নি। একটা মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আন্দোলন ধাপে ধাপে এগিয়েছে। আন্দোলন যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে চলে, সেই চেষ্টা ছিল তাঁদের। তাঁরা কোনো একক নেতৃত্বের ধারায় না গিয়ে, আন্দোলনকে সামগ্রিকভাবে সমন্বয় করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এভাবেই নেতার পরিবর্তে ‘সমন্বয়ক’–এর ধারণাটি এসেছে।
আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে নাহিদ ইসলাম বলেন, ১৬ জুলাই যখন ব্যাপক হত্যাকাণ্ড শুরু হয়, তখন থেকেই তাঁরা অনুভব করেছিলেন, এ আন্দোলন এবার সরকার পতনের চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘পরবর্তী প্রজন্ম যেন আরেকটি ফ্যাসিবাদের মুখোমুখি না হয়, রাষ্ট্রকে যেন কোনো স্বৈরাচার আবার দখল করতে না পারে, জুলাই অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে সেই পথে যাত্রা শুরু হয়েছে। এই যাত্রা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে।’
রিফাত রশিদ কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনের এক দফা দাবি পর্যন্ত আন্দোলনের ধাপগুলো পর্যায়ক্রমিকভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কোনো একক নেতৃত্বে এই আন্দোলন হয়নি। এর অনেকগুলো স্তর ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে বসে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন শুরু করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীরা অংশ নেবে কি না, এ নিয়ে অনেক আশঙ্কা ছিল। পরে মিছিল বের করলে অনেক শিক্ষার্থী যোগ দেয়। বিভিন্ন হলের গণরুমে নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। গণরুমে নির্যাতনের জন্য তারা অনেক বিক্ষুব্ধ ছিল। পরবর্তী ধাপগুলোতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা এবং স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে অংশ নিয়েছে।
আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করে রিফাত রশিদ বলেন, তাঁরা অনেক সময় সারা দিন রাজপথে আন্দোলন করে চানখাঁরপুলে একটি বিশেষ বাড়িতে সবাই মিলে রাত কাটাতেন। রাতে পরের দিনের কর্মসূচি ঠিক করা হতো। পরবর্তী সময়ে যখন ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিল, ব্যাপক ধরপাকড় চলছিল, তখন অনেক সময় সমন্বয়কেরা নিজেরাই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দিতেন। এভাবে আগস্টের প্রথম দিনেই তাঁরা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছিলেন যে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতন নিশ্চিত। সে সময়ই তাঁরা পরবর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রাথমিকভাবে মনোনীত করেছিলেন। সবারই তাতে সম্মতি ছিল।
সবশেষে আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া তাঁর বই সম্পর্কে বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পরিধি এত ব্যাপক ছিল যে ১২০ পৃষ্ঠার এই বইয়ে তার সম্পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরা যায়নি। স্মৃতি থেকে যেন ঘটনাগুলো হারিয়ে না যায়, সে কারণেই তিনি লিখিত আকারে বিষয়টিকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। অনেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, কিন্তু বইয়ে তত গুরুত্ব দিয়ে তাঁদের তুলে আনতে পারেননি। অনেকের নাম হয়তো বাদ পড়েছে। এই সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পরবর্তী সময়ে সম্ভব হলে তিনি বইটি আরও বিস্তারিত করার চেষ্টা করবেন। তিনি আশা করেন, জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে বিভিন্ন পর্যায় থেকে আরও অনেকে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ নিয়ে বই লিখবেন। তাতে এই অভ্যুত্থানের একটি সম্পূর্ণ চিত্র সম্পর্কে জানা যাবে। তিনি বইটি লেখার পরামর্শ দেওয়ার জন্য উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, অনুলিখনের জন্য প্রথম আলোর প্রতিবেদক আসিফ হাওলাদার, প্রথমা প্রকাশন এবং যাঁরা বিভিন্নভাবে প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বলেন, জুলাই আন্দোলনের অনেক অনুঘটক ছিল। অনেক ধাপ ছিল। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিভিন্ন এলাকায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলন হয়েছে। আন্দোলন অবধারিতভাবে তার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেছে। তিনি বলেন, ’৯০–এ স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের মাত্র ১৮ বছর পরে আবার একটি নজিরবিহীন ফ্যাসিবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। এই সংকটের একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। জুলাই অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে আবার সেই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যাঁরা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন, তাঁদের এই ত্যাগ তখনই সফল হবে, যখন এই সুযোগ সঠিকভাবে কাজে লাগানো হবে। এ জন্য এই লড়াইটা জারি রাখতে হবে।