নির্বাচনের আগে এবারও ‘গায়েবি’ মামলা
২০১৮ সালের মতো এবারও নির্বাচনের আগে গায়েবি মামলার অভিযোগ। এবার বাদী বেশির ভাগ ক্ষমতাসীন দলের নেতা।
পুরান ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা সূত্রাপুরের বানিয়ানগর মোড়। এই মোড়ে গত ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ২০ থেকে ২৫ নেতা-কর্মী সরকারবিরোধী স্লোগান দিতে শুরু করেন। সরকারবিরোধী স্লোগান দিতে নিষেধ করলে তাঁরা অতর্কিতভাবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালান। পরে হত্যার উদ্দেশ্যে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা খয়ের উদ্দিন আহমেদের করা মামলার এজাহারের ভাষ্য এটি। কিন্তু ঘটনাস্থলের ও আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলে কেউ এমন ঘটনা দেখেছেন বা শুনেছেন, সেটা বলতে পারেননি।
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বিস্ফোরিত ককটেলের অংশবিশেষ এবং দুটি অবিস্ফোরিত ককটেল আলামত হিসেবে জব্দ করেছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়। কিন্তু মামলার বাদী ইটপাটকেল ছুড়েছে বলে দাবি করলেও কোনো ককটেল হামলা হয়নি বলে জানান।
নাশকতার ঘটনা ঘটেছে বলেই পুলিশ বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা নিয়েছে। মামলায় যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁদের গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হচ্ছে। কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না।
এ রকম হামলার অভিযোগ এনে গত সাত মাসে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় কেবল আওয়ামী লীগের নেতারা বাদী হয়ে ৪০টি মামলা করেছেন। গত বছরের ১৭ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩০ মে পর্যন্ত সময়ে করা এসব মামলায় আসামি হিসেবে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ১ হাজার ৭০১ জন নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা আরও ২ হাজার ৫৭৫ জন।
বিএনপির নেতাদের দাবি, এ সবই ‘গায়েবি মামলা’। অর্থাৎ, ঘটনা ঘটেনি, তারপরও মামলা দেওয়া হয়েছে। যার কারণে মামলার বিবরণ ও ধারা প্রায় একই রকম।
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সারা দেশে এ রকম অসংখ্য মামলা হয়েছিল পুলিশ বাদী হয়ে। ওই নির্বাচনের আগের তিন মাসে (সেপ্টেম্বর-নভেম্বর) কেবল ঢাকা মহানগরে নাশকতার অভিযোগে ৬৯৭টি মামলা হয়। এর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরেই ঢাকায় মামলা হয়েছিল ৫৭৮টি। বিস্ফোরক দ্রব্য ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা এসব মামলা তখন ‘গায়েবি মামলা’ নামে পরিচিতি পায়। নির্বাচনকে সামনে রেখে ওই সময়ের মতো এবারও ‘গায়েবি’ মামলা করা হচ্ছে উল্লেখ করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলছেন, এসব মামলার উদ্দেশ্য, বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঘরছাড়া করা। তবে এবারের ব্যতিক্রম হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের মামলার বাদী করা হচ্ছে।
গত বছরের ১৭ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩০ মে পর্যন্ত সময়ে করা এসব মামলায় আসামি হিসেবে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ১ হাজার ৭০১ জন নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা আরও ২ হাজার ৫৭৫ জন।
অবশ্য এবার (সাত মাসে) ঢাকার বিভিন্ন থানায় পুলিশের করা এমন ১০টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশের ওপর হামলা, হত্যাচেষ্টা ও ককটেল নিক্ষেপের অভিযোগে করা এ ১০টি মামলায় বিএনপির ২৫০ জন নেতা-কর্মী এবং অজ্ঞাতনামা আরও ১১০ জনকে আসামি করা হয়। এগুলোকেও ‘গায়েবি মামলা’ বলছেন বিরোধী দলের স্থানীয় নেতারা। এর বাইরে বিএনপির কর্মসূচিকেন্দ্রিক আরও কিছু মামলা হয়েছে। সেগুলো এই হিসাবে ধরা হয়নি।
নতুন করে গায়েবি মামলা করার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র, গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাশকতার ঘটনা ঘটেছে বলেই পুলিশ বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা নিয়েছে। মামলায় যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁদের গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হচ্ছে। কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না।’
২০১৮ সালে দেখেছিলাম, পুলিশ বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দিয়ে ঘরছাড়া করেছিল। এবারও আওয়ামী লীগের নেতাদের ওপর হামলার নাটক সাজিয়ে বিএনপির শত শত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছেন সরকারদলীয় নেতারা
ঢাকায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাদের করা ৪০ মামলার মধ্যে ৩৫টি হয়েছে গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে। বিএনপির ধারাবাহিক বিভাগীয় সমাবেশ ও ১২ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশ ঘিরে রাজনীতিতে যে উত্তাপ তৈরি হয়েছিল, তখন এসব মামলা হয়। এতে মূল অভিযোগ, বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ওপর দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়ে জখম করেছেন, হত্যার চেষ্টা করেছেন, গাড়ি ভাঙচুর করেন, দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন।
এসব অভিযোগকে ‘ডাহা মিথ্যা’ দাবি করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন হামলা কিংবা ককটেল বিস্ফোরণের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঘরছাড়া করতে আওয়ামী লীগের নেতারা নতুন ধরনের গায়েবি মামলা দিচ্ছেন।’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘ ২০১৮ সালে দেখেছিলাম, পুলিশ বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দিয়ে ঘরছাড়া করেছিল। এবারও আওয়ামী লীগের নেতাদের ওপর হামলার নাটক সাজিয়ে বিএনপির শত শত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছেন সরকারদলীয় নেতারা।’
আমার জানামতে, সেদিন সন্ধ্যার সময় এখানে কোনো মারামারির ঘটনা ঘটেনি। যদি ককটেল বিস্ফোরিত হতো, তাহলে অবশ্যই আমরা তা শুনতাম।
ঘটনা নিয়ে নানা রকম বক্তব্য
সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের এ ধরনের মামলা রুজু করার পরিণতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পাবে। এটা ভবিষ্যতে দেশকে অশান্ত হয়ে যাওয়ার কারণে পরিণত হতে পারে।
যেসব স্থানে হামলা ও ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে মামলা হয়েছে, এ রকম ১৭টি মামলার ঘটনাস্থলে (১৪ মার্চ থেকে ১৯ জুলাই) সরেজমিন অনুসন্ধান করেন এই প্রতিবেদক। ঘটনার দিন কী ঘটেছিল, তা জানতে সেখানকার বাসিন্দা, দোকানিসহ আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। এর মধ্যে ১৫টি স্থানের লোকজন জানান, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা তাঁরা দেখেননি বা শোনেননি। তবে ডেমরার ডগাইর বাজার ও খিলগাঁওয়ের গুদারাঘাট— দুই স্থানের কয়েকজন বাসিন্দা বলেছেন, মামলায় উল্লেখিত তারিখে ডগাইর বাজারের কাছে যুবলীগের কার্যালয়ের সামনে ও গুদারাঘাটে জসিম হোটেলের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ তাঁরা শুনেছেন। কে বা কারা ককটেল ফাটিয়েছেন বলতে পারেননি কেউ।
এই প্রতিবেদনের শুরুতে উল্লেখ করা মামলার ঘটনাস্থল সূত্রাপুরের বানিয়ানগর মোড়। সেখানকার একটি দোকানের কর্মচারী মকবুল হোসেনের সঙ্গে কথা হয় গত ১৪ মার্চ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জানামতে, সেদিন সন্ধ্যার সময় এখানে কোনো মারামারির ঘটনা ঘটেনি। যদি ককটেল বিস্ফোরিত হতো, তাহলে অবশ্যই আমরা তা শুনতাম।’ এই মামলার বাদী খয়ের উদ্দিন আহমেদও প্রথম আলোকে বলেছেন, ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেনি। তবে তিনি দাবি করেন, ‘সেদিন অতর্কিতভাবে বিএনপির লোকজন আমাদের মারধর করেন। ইটপাটকেল ছুড়ে কয়েকজনকে আহত করেন।’ খয়ের নিজেকে ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের ৩ নম্বর ইউনিট আওয়ামী লীগের সভাপতি বলে দাবি করেন।
বাদীও বলছেন ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেনি, তাহলে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা কীভাবে হয়—এমন প্রশ্নের জবাবে সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মইনুল ইসলাম ১৮ জুলাই প্রথম আলোকে বলেন, ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল বলেই মামলা নেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
আরেক মামলায় বলা হয়, গত বছরের ২৩ নভেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে শাহজাহানপুরের বাগিচা মসজিদের সামনে ওয়াসার পানির পাম্পের মাঠে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বৈঠক করছিলেন। তখন বিএনপির নেতা-কর্মীরা তাঁদের ওপর হামলা করেন। ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান।
মামলার দুই সপ্তাহ পর ৭ ডিসেম্বর কথা হয় জব্দ তালিকার সাক্ষী ওয়াসার পাম্প অপারেটর আতারুল হকের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী পানির পাম্পের মাঠে অবস্থান করছিলেন। তবে তাঁদের কাউকে মারধর করতে দেখেননি। তবে বিকট শব্দ শুনেছিলেন।
একই দিন পাম্পের সামনের একটি দোকানের মালিক মো. জয়নাল প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন ওয়াসার পানির পাম্পের মাঠে কোনো মারামারি ঘটনা তিনি দেখেননি।
সেদিন অতর্কিতভাবে বিএনপির লোকজন আমাদের মারধর করেন। ইটপাটকেল ছুড়ে কয়েকজনকে আহত করেন।
এ ব্যাপারে সম্প্রতি কথা হয় শাহজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফারুকুল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, মামলাটি তদন্তাধীন। তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
আরেকটি মামলায় বলা হয়, গত বছরের ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় খিলগাঁওয়ের ত্রিমোহিনী গুদারাঘাটে জসিম হোটেলের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মারধর করা হয়।
জসিম হোটেলের মালিক মো. সাদ্দাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন আমার দোকানের সামনে বিকট আওয়াজ হয়েছিল। তখন আমি দোকানে ছিলাম। তবে এখানে কোনো মারামারি হয়নি।’ এলাকার ফলের দোকানদার শাহাবুদ্দিন বলেন, সেদিন বাজারে কোনো মারধরের ঘটনা ঘটেনি। স্থানীয় কয়েকজন ককটেল ফাটিয়েছিলেন। তাঁরা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন।
যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, তারাই সেদিন ককটেল ফুটিয়েছিল। বিএনপির লোকজন এখন মিথ্যা কথা বলছে
তবে খিলগাঁও থানার তৎকালীন ওসি (বর্তমানে শাহজাহানপুর থানায় কর্মরত) ফারুকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, তারাই সেদিন ককটেল ফুটিয়েছিল। বিএনপির লোকজন এখন মিথ্যা কথা বলছে।’
অন্য এক মামলার বিবরণ বলছে, গত বছরের ১৭ নভেম্বর রাত ৮টা ৩৫ মিনিটের দিকে ডেমরার ডগাই বাজারসংলগ্ন পশ্চিমপাড়ার যুবলীগ কার্যালয়ের সামনে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের অতর্কিতে বেধড়ক পেটাতে শুরু করেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। তাঁরা পরে তিন থেকে চারটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান।
ডগাই বাজারের পানবিক্রেতা ইউসূফ আলী গত ১৪ মার্চ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানকার যুবলীগের অফিসের সামনে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কোনো মারামারির কথা শুনিনি। তবে ককটেলের আওয়াজ শুনেছিলাম।’
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলায় ব্যবহৃত ২৫০টি বাঁশের লাঠি, রড, কাঠের টুকরা ইত্যাদি উদ্ধার দেখানো হয়েছে।বেশির ভাগ ঘটনা সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টার মধ্যে ঘটেছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়। এতগুলো হামলা-মামলার ঘটনা ঘটলেও ঘটনার পরপর গণমাধ্যমে সেভাবে খবর দেখা যায়নি।
ডেমরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুর রহমান গত ১৬ মার্চ প্রথম আলোকে বলেন, যুবলীগের অফিসের সামনে হামলার খবর পেয়ে সেদিন ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়েছিলেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা।
পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ
বেআইনিভাবে জড়ো হওয়া, দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া, ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো ও হত্যাচেষ্টা—পুলিশের করা ১০ মামলায় এজাহারে মূলত এসব অভিযোগ করা হয়েছে।
একটি মামলায় বলা হয়, গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টা ১০ মিনিটে শ্যামপুরের গেন্ডারিয়া বাজারসংলগ্ন নতুন সড়কের ওপর বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা সরকারবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিতে শুরু করেন। পরে পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্য করে পাথর ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। একই সঙ্গে তাঁরা হত্যার উদ্দেশ্যে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান। এতে পুলিশের চার সদস্য আহত হন।
ঘটনাস্থলসংলগ্ন স্থানীয় দোকানদার হান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশের ওপর বিএনপির নেতা-কর্মীদের হামলা কিংবা ককটেল মারার কোনো ঘটনা আমি দেখিনি।’
একই এলাকায় গত ২৩ মে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগে পৃথক মামলা হয়েছে। মামলায় বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাজশাহীর বিএনপির নেতা আবু সাঈদের দেওয়ার হত্যার হুমকির প্রতিবাদে ২৩ মে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে শ্যামপুরের মুন্সিবাড়ি ঢালে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা একত্রিত হন।
তখন শ্যামপুর থানা বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠন ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেখানে হামলা করেন। এতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা গুরুতর জখম হন। সে সময় অনেকগুলো ককটেলের বিস্ফোরণও ঘটানো হয়।
ঘটনাস্থল মুন্সিবাড়ির ঢালের একটি দোকানের মালিক আবদুল মালেক ১০ জুলাই প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ঢালে গত মে মাসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো গন্ডগোল হয়নি। বোমা মারার কোনো ঘটনাও আমি দেখিনি।’
মামলার বিবরণের সঙ্গে ঘটনাস্থলের লোকজনের ভাষ্যের এমন গরমিল সম্পর্কে জানতে চাইলে শ্যামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক বিষয়ে সাধারণ মানুষ কথা বলতে ভয় পায়। এ জন্য সাধারণ মানুষ সঠিক কথা বলেনি। বাস্তবে সেখানে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল। খবর পেয়ে পুলিশ সেখান গিয়ে ককটেলের অংশবিশেষ উদ্ধার করে।
গত ৬ মে কদমতলী থানায় বিএনপির ৭০ জন নেতা-কর্মী এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৮০থেকে ৯০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন ৬১ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার হোসেন। এজাহারে বলা হয়, ৫ মে দেলোয়ারের নেতৃত্বে ৩০থেকে ৩৫ জনের একটি মিছিল বের করলে কুদরত আলী বাজার তিন রাস্তার মোড়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় মিছিলে হামলা করেন আসামিরা। হত্যার উদ্দেশ্যে পরপর কয়েকটি ককটেল ফাটান। ককটেলের আঘাতে দেলোয়ারসহ তিনজন রক্তাক্ত জখম হন। পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং রাত ৮টা ২৫ মিনিটে দুটি অবিস্ফোরিত ককটেল ও দুটি বিস্ফোরিত ককটেলের আলামত জব্দ করে।
এই মামলার জব্দ তালিকার সাক্ষী করা হয় মো. মমিনকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই দিন সেখানে কুদরত আলী বাজার তিন রাস্তার মোড়ে কোনো হামলা কিংবা ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা তিনি দেখেননি। দেলোয়ার হোসেন (বাদী) একটি কাগজে সই দিতে বললে তিনি সই দিয়েছিলেন।
তবে দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ওই দিন বিএনপির লোকজন তাঁদের ওপর ইটপাটকেল ছুড়ে মেরেছিলেন, এতে কয়েকজন আহত হন। তবে ককটেলের আঘাতে কেউ জখম হননি।
আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাদের ওপর হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ হলে জড়িত বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে—এটাই স্বাভাবিক। হামলার ঘটনা ঘটেছে বলেই তো আমাদের নেতারা মামলা করেছেন।
সব ঘটনাই সন্ধ্যার পর
৫০টি মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিএনপির নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও পুলিশ সদস্যদের হত্যার উদ্দেশ্যে ৮৩টি ককটেলের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটিয়েছেন। বিভিন্ন ঘটনাস্থল থেকে ২৯টি অবিস্ফোরিত ককটেল উদ্ধার দেখিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলায় ব্যবহৃত ২৫০টি বাঁশের লাঠি, রড, কাঠের টুকরা ইত্যাদি উদ্ধার দেখানো হয়েছে। বেশির ভাগ ঘটনা সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টার মধ্যে ঘটেছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়। এতগুলো হামলা-মামলার ঘটনা ঘটলেও ঘটনার পরপর গণমাধ্যমে সেভাবে খবর দেখা যায়নি।
ঢাকা মহানগরের যে ৪০টি স্থানে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের ওপর হামলার অভিযোগে মামলা হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই ঢাকা দক্ষিণ সিটি এলাকায় পড়েছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাদের ওপর হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ হলে জড়িত বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে—এটাই স্বাভাবিক। হামলার ঘটনা ঘটেছে বলেই তো আমাদের নেতারা মামলা করেছেন।’
৫০টি মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিএনপির নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও পুলিশ সদস্যদের হত্যার উদ্দেশ্যে ৮৩টি ককটেলের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটিয়েছেন।
এ ধরনের মামলায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিদ্বেষ আরও বাড়াবে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের এ ধরনের মামলা রুজু করার পরিণতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পাবে। এটা ভবিষ্যতে দেশকে অশান্ত হয়ে যাওয়ার কারণে পরিণত হতে পারে।’