নির্বাচনকালীন সরকার হঠাৎ আলোচনায়
নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিলে বিএনপিকে নির্বাচনকালীন সরকারে রাখার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ। তখন দলটির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বিএনপিকে প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। ৯ বছর আগে নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে আওয়ামী লীগের দেওয়া ওই প্রস্তাব বিএনপি গ্রহণ করেনি। এখন আরেকটি জাতীয় নির্বাচন সামনে। এবারও দলটির পক্ষে সেই একই ধরনের প্রস্তাব সামনে নিয়ে আসা হয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত রোববার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, বিএনপি আগামী নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিলে দলটিকে নির্বাচনকালীন সরকারে রাখার বিষয়টি বিবেচনা করা হতে পারে।
তবে এ ধরনের প্রস্তাব নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে চলমান বিরোধ বা সংকট সমাধানের জন্য কোনো সুযোগ তৈরি করবে কি না, অথবা আওয়ামী লীগ কেন এ প্রস্তাব হঠাৎ সামনে আনল, সে প্রশ্ন উঠছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো এ প্রস্তাবের ব্যাপারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
বিএনপি যদি বলে, “আমরা নির্বাচনে আসব।” নির্বাচনে এলে তখন এক কথা। তারা নির্বাচন করবেই না তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া। তারা এই সংসদকে চায় না। মন্ত্রিসভা, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চায়। এসব শর্তারোপের মধ্যে আমরা কীভাবে বলব যে আপনারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিতে আসুন বা অন্য কোনো মন্ত্রণালয় আপনাদের দিচ্ছি? তাদের তো সম্পূর্ণ উত্তর আর দক্ষিণ মেরুর অবস্থানওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধ এখনো একই জায়গায় রয়ে গেছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনে ছিল। তখন তাদের সহিংস আন্দোলনের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারে থেকেই একতরফা নির্বাচন করেছিল। সে সময়ও সংবিধানের বাইরে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের দাবি মানতে রাজি হয়নি আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমান সরকার পদত্যাগ করার পর নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে, এটিই তাঁদের অবস্থান।
অবশ্য ২০১৪ সালের সেই নির্বাচনের আগে সংবিধানের ভেতরে থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে অংশীদার করার প্রস্তাব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। সেই প্রস্তাবে বিএনপিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল। ওই প্রস্তাব বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছিল। পরে মন্ত্রিসভায় কিছুটা রদবদল হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার পাশাপাশি শরিকদের দু–তিন নেতাকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত রদবদল করা ওই মন্ত্রিসভাই নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে কাজ করেছে।
দলটির অন্য যে চারজন নেতার সঙ্গে কথা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সভাপতিমণ্ডলীর আরও দুজন সদস্য এবং দুজন কেন্দ্রীয় নেতা। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধী দলের অব্যাহত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের ভেতরে বিভিন্ন সময় নানা কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে রাখার বিষয়ে দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যকে তাঁরা কৌশলের অংশ হিসেবে দেখছেন।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনও হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে। এখন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পুরোনো দাবিতেই আন্দোলনে রয়েছে। দাবি আদায়ে এবার দলটি চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলছে। এমন পটভূমিতে আওয়ামী লীগ তাদের অধীনে নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দেওয়ার সেই পুরোনো প্রস্তাব সামনে নিয়ে এসেছে। এর সঙ্গে সেই পুরোনো শর্তের কথাই বলা হচ্ছে যে বিএনপিকে আগে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিতে হবে।
গত রোববার বনানীর সেতু ভবনে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তখন একজন সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, ২০১৪ সালের ভোটের আগে নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি মন্ত্রণালয় দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এখন নির্বাচনের সময় বিএনপির কাউকে মন্ত্রিত্ব দেওয়ার সম্ভবনা আছে কি না?
আওয়ামী লীগ সংবিধানের বাইরে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানবে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে রাখার প্রস্তাবের ব্যাপারে বিরোধী দলগুলো ইতিবাচক মনোভাব দেখাবে বলে মনে হয় না। ফলে এ প্রস্তাব নতুন করে সামনে আনার বিষয়টি আওয়ামী লীগের কোনো কৌশলের অংশ হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তাতে সমঝোতা হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।লেখক–গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ
সাংবাদিকের এ প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত যদি নিতে হয়, তাহলে সংবিধানের মধ্যেই থাকতে হবে। সংবিধানে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকলে আপনি যেটা বললেন, এটাতে কোনো অসুবিধা নেই।’
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ‘বিএনপি যদি বলে, “আমরা নির্বাচনে আসব।” নির্বাচনে এলে তখন এক কথা। তারা নির্বাচন করবেই না তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া। তারা এই সংসদকে চায় না। মন্ত্রিসভা, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চায়। এসব শর্তারোপের মধ্যে আমরা কীভাবে বলব যে আপনারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিতে আসুন বা অন্য কোনো মন্ত্রণালয় আপনাদের দিচ্ছি? তাদের তো সম্পূর্ণ উত্তর আর দক্ষিণ মেরুর অবস্থান।’
সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি বিবেচনার কথা বললেও এর মধ্যে একটি বার্তা রয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন।
ওবায়দুল কাদেরের ওই বক্তব্যের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের পাঁচজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের মধ্যে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য এ ধরনের বক্তব্য দেওয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, দলের কোনো ফোরামে এ বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা তাঁর জানা নেই।
দলটির অন্য যে চারজন নেতার সঙ্গে কথা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সভাপতিমণ্ডলীর আরও দুজন সদস্য এবং দুজন কেন্দ্রীয় নেতা। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধী দলের অব্যাহত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের ভেতরে বিভিন্ন সময় নানা কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে রাখার বিষয়ে দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যকে তাঁরা কৌশলের অংশ হিসেবে দেখছেন।
এর ব্যাখ্যাও দিলেন দলটির একজন কেন্দ্রীয় নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে সংকট সমাধানের ব্যাপারে সরকারের দিক থেকে সমঝোতার কোনো চেষ্টা নেই—এ ধরনের একতরফা বক্তব্য বিএনপি তুলে ধরছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে। ফলে সরকার নমনীয় নয় বা সমঝোতা চায় না, এমন একটি ধারণা তৈরি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহলে। যেটা সরকারের জন্য নেতিবাচক হতে পারে। এ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই আওয়ামী লীগ দেখাতে চাইছে যে তারাও সমঝোতা চায় এবং তা হতে হবে সংবিধানের ভেতরে থেকে। আর সে জন্যই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বক্তব্য দিয়ে থাকতে পারেন।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম প্রথম আলোকে বলেন, সংবিধান সংশোধন করা এবং নির্দলীয় সরকারের দাবি কোনোভাবেই মানা হবে না। সংবিধানের ভেতরে থেকেই কোনো সমঝোতা হলে তাতে আওয়ামী লীগের আপত্তি থাকবে না। সেই অবস্থান থেকেই দলের সাধারণ সম্পাদক বক্তব্য দিয়েছেন বলে তিনি মনে করেন।
বর্তমান সংসদে বিএনপির যেহেতু কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, ফলে দলটিকে নির্বাচনকালীন সরকারে নিতে হলে সংবিধান অনুযায়ী তা কীভাবে সম্ভব হবে, সেই প্রশ্নও রয়েছে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, সংবিধান অনুয়ায়ী মন্ত্রিসভায় ১০ সদস্যের বিপরীতে একজনকে টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী (সংসদ সদস্য নন) করা যায়। সে অনুযায়ী সরকারে ২০ জন মন্ত্রী থাকলে দুজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হতে পারেন। তবে তাতে সমস্যা সমাধান কতটা সম্ভব হবে, সেটিও তাঁর প্রশ্ন।
ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য নিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক নয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমান সরকার পদত্যাগ করার পর নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে, এটিই তাঁদের অবস্থান।
এ বিষয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের যে সরকারব্যবস্থা, সেখানে ৯৯ শতাংশ ক্ষমতার মালিক প্রধানমন্ত্রী নিজে। বাকি সবাই মিলে ১ শতাংশ। সেখানে কে কয়টা মন্ত্রণালয় পেল, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। কারণ, সেখানে গিয়ে কারও পক্ষে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব নয়, যতক্ষণ এই এককেন্দ্রিক ক্ষমতার পরিবর্তন না হয়।’
গত রোববার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাঁর বক্তব্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে বিদেশিদের কোনো চাপ না থাকার কথাও বলেছিলেন। বিরোধী দলগুলো এ বক্তব্যেরও সমালোচনা করেছে। বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠক থেকে বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন সরকার কি বিদেশি চাপ বা হস্তক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করবে? এ ধরনের চিন্তা দায়িত্বশীলতার পরিচয় নয় বলে গণতন্ত্র মঞ্চ মনে করে।
বিএনপিকে নির্বাচনকালীন সরকারে রাখার প্রস্তাবের বিষয়ে লেখক–গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ সংবিধানের বাইরে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানবে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে রাখার প্রস্তাবের ব্যাপারে বিরোধী দলগুলো ইতিবাচক মনোভাব দেখাবে বলে মনে হয় না। ফলে এ প্রস্তাব নতুন করে সামনে আনার বিষয়টি আওয়ামী লীগের কোনো কৌশলের অংশ হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তাতে সমঝোতা হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।