ফিরে দেখা
সেই ৫ মে রাতে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ ঘিরে কী ঘটেছিল
১১ বছর আগে ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে আলোচনায় এসেছিল কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগ ও নারী নীতির বিরোধিতা করাসহ ১৩ দফা দাবি তুলে হেফাজতে ইসলাম ওই কর্মসূচি নিয়েছিল। ২০১৩ সালের ৫ মে দিনভর উত্তেজনা ও সহিংসতা ছড়িয়েছিল সংগঠনটির ওই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে। সেই রাতে রাজধানীর অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলের শাপলা চত্বর ঘিরে তৈরি হয়েছিল এক ভীতিকর পরিবেশ। শেষ পর্যন্ত পুলিশ–র্যাব ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির অভিযানে খালি করা হয়েছিল শাপলা চত্বর। কী ঘটেছিল সেই রাতে।
শাপলা চত্বরের মঞ্চে চলছে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের উত্তেজনাকর বক্তব্য। বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়ায় ওই এলাকায় ঘুট ঘুটে অন্ধকার। অন্যদিকে অবস্থানকারীদের সরিয়ে দিতে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির শত শত সদস্য প্রস্তুত হয়ে আছেন পল্টনের তোপখানা মোড়, ফকিরাপুল ও দিলকুশা এলাকায়। অবস্থানকারীদের সরে পড়ার জন্য খোলা রাখা হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে কমলাপুর স্টেশন যাওয়ার রাস্তা এবং বঙ্গভবনের দিকের রাস্তা।
এই চিত্র ছিল ২০১৩ সালের ৫ মে রাত সোয়া একটায়। সংবাদ সংগ্রহের জন্য সে সময় আমি পৌঁছেছিলাম তোপখানা মোড়ে। সেখানে একটা ভুতুড়ে পরিবেশে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কয়েকজন সাংবাদিকের দেখা পেয়ে তাঁদের দলে যুক্ত হলাম। এর আগে আমি নটর ডেম কলেজ থেকে অল্প দূরত্বে ফকিরেরপুল মোড় পর্যন্ত গিয়েছিলাম। সেখানেও একই পরিস্থিতি দেখতে পাই।
আমাদের সাংবাদিকদের দলটি তোপখানা মোড়েই অপেক্ষায় থাকি। সেখানে যেকোনো সময় অভিযান শুরু হতে পারে, সেই প্রস্তুতি নিয়ে আছেন তিন স্তরে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির শত শত সদস্য।
তোপখানা মোড়ে দেখা যায়, রাত দেড়টার দিকে বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা এগোনোর চেষ্টা করেন। তাঁরা প্রথমে হাতমাইক ব্যবহার করে অবস্থানকারীদের সরে যেতে বলেন। কিন্তু মঞ্চ থেকে তখনো আসতে থাকে উত্তেজনাকর বক্তব্য। ঘণ্টাখানেক এভাবে চলে।
মূল অভিযান শুরু রাত পৌনে তিনটায়
বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ—তিন বাহিনীর সদস্যরা ফাঁকা গুলি আর কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে থাকেন। থেমে থেমে সাউন্ড গ্রেনেডও ব্যবহার করা হয়। শত শত ফাঁকা গুলি, সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ এবং অন্ধকার এলাকায় এসবের আলোর ঝলকানি মুহূর্তেই ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। ১০ মিনিট ধরে চলে এ পরিস্থিতি। এরই মধ্যে একপর্যায়ে মঞ্চের মাইক বন্ধ হয়ে যায়। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ফাঁকা গুলি, কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে এগোতে শুরু করেন শাপলা চত্বরের দিকে।
বিরতিহীন ফাঁকা গুলি, কাঁদানে গ্যাস আর সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দের মধ্যেই আমরা সাংবাদিকেরাও এগোতে থাকলাম। হেঁটে এগোনোটাও ছিল দুর্বিষহ। পায়ের নিচে পড়ছে সারা দিনের সহিংসতায় আগুনে পোড়া বিভিন্ন জিনিসপত্রের ছাই, ভাঙা কাচ। আর ইটের টুকরা ও পাথরে পা পড়ে হোঁচট খেতে হয় বারবার।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তোপখানা মোড় থেকে এগোনো শুরু করার পর ১০ মিনিটেই পৌঁছে যান শাপলা চত্বরে। ট্রাকের ওপর ভ্রাম্যমাণ মঞ্চও খালি হয়েছিল মুহূর্তেই।
তখন আমরা সাংবাদিকেরাও সেখানে পৌঁছে যাই। সেখানে দেখা যায়, নটর ডেম কলেজের সামনে রাস্তা ও দিলকুশা এলাকা থেকেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রায় একই সময়ে শাপলা চত্বরে পৌঁছেছেন। তখন তিন দিক থেকে আসা পুলিশ, র্যাব, বিজিবির দখলে শাপলা চত্বর।
সেখানে মঞ্চের পাশে একটি ভ্যানের ওপর কাফনের কাপড় এবং পলিথিন দিয়ে মোড়ানো চারটি মৃতদেহ ছিল। এগুলো দিনের সংঘর্ষে নিহতদের মৃতদেহ বলে পুলিশ দাবি করে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দখলের পর
অভিযানের সময় হেফাজতের শত শত কর্মী–সমর্থক মতিঝিল এলাকায় সোনালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পুলিশ পুরো এলাকার দখল নেওয়ার পর বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নেওয়াদের বের করে এনে ওই এলাকা ছেড়ে যেতে সহায়তা করে।
আমরা সাংবাদিকেরা সে সময় দেখছিলাম, হেফাজতের শত শত কর্মী–সমর্থক মাথার ওপর দুই হাত তুলে লাইন ধরে পুলিশের কর্ডনের মধ্য দিয়ে ওই এলাকায় বিভিন্ন ভবন থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। তাঁদের বেশির ভাগ ছিল মাদ্রাসার ছাত্র ও কিশোর। তাঁদের চোখে–মুখে ছিল অজানা আতঙ্ক, ভয়।
সেই রাতে তাঁদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। অনেকে বিভিন্ন জেলা–উপজেলার মাদ্রাসা থেকে এসেছিলেন। রাজধানী ঢাকার রাস্তা তাঁদের অচেনা। কীভাবে ফিরে যাবেন, সেই ধারণাও তাঁদের ছিল না। যদিও পুলিশ তাঁদের বঙ্গভবনের সামনের রাস্তা দিয়ে এবং কমলাপুর রেলস্টেশনের দিকে পাঠিয়ে দিচ্ছিল।
তবে ভোর চারটার সময়ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের থেমে থেমে ফাঁকা গুলি ছুড়তে দেখা যায়। তাঁরা তল্লাশি চালান আশপাশের ভবনগুলোতে।
রাতের অভিযানে নিহতের সংখ্যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। আড়াই হাজারের মতো নিহত হওয়ার অভিযোগ তুলেছিল বিভিন্ন দল। তবে পুলিশ বলেছিল, অভিযানের সময় আহত একজন পরে হাসপাতালে মারা যান। আর দিনের সহিংসতায় নিহত চারজনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল মঞ্চের কাছে একটি ভ্যানে।
২০১৩ সালের ৫ মে দিনের সহিংসতা এবং পরদিন ৬ মে দুই দিনে সারা দেশে সহিংসতায় ২৮ জনের নিহত হওয়ার কথা বলেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
৫ মে দিনভর সংঘর্ষ–সহিংসতা
কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগসহ ১৩ দফা দাবি তুলে হেফাজতে ইসলাম প্রথমে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি নিয়েছিল ২০১৩ সালে ৫ মে।
সেদিন ভোর পাঁচটায় ফজরের নামাজের পরই ঢাকার প্রবেশপথগুলো দখলে নিয়েছিলেন হেফাজতের নেতা–কর্মীরা। ঢাকার উত্তরে গাবতলী বাস টার্মিনাল, টঙ্গী এবং দক্ষিণে সায়েদাবাদের কাছে কাঁচপুর ব্রিজসহ রাজধানীকে ঘিরে ছয়টি প্রবেশমুখেই অবরোধ তৈরি করেছিলেন হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে সারা দেশ থেকে আসা বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসার হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবরোধকারীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ায়। এরই মধ্যে সংগঠনটির নেতৃত্ব ঢাকার ভেতরে প্রবেশ করে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে তারা।
হেফাজতে ইসলামের একজন সাবেক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, অনেকটা আকস্মিকভাবেই তাঁরা ঢাকায় প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শাপলা চত্বরে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর অনুমতির জন্য পুলিশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন।
৫ মে সকালে দফায় দফায় এই অলোচনা চলে। অনুমতি মেলার আগেই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কয়েকটি মিছিল ঢুকে পড়ে ঢাকা নগরীতে। মিছিলগুলো শাপলা চত্বরে যাওয়ার সময় সংঘর্ষ শুরু হয় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কাছে এবং পল্টন এলাকায়।
সে সময় পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত শাপলা চত্বরে এসে শুধু মোনাজাত করেই কর্মসূচি শেষ করার শর্তে পুলিশ অনুমতি দিয়েছিল।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও পল্টন এলাকায় সহিংসতা চলে সন্ধ্যার পরও। সেখানে হেফাজতের মিছিলে আওয়ামী লীগের একদল নেতা–কর্মী হামলা করেছিলেন বলে অভিযোগ করে আসছে সংগঠনটি। তবে আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে, তাঁদের কার্যালয়ে হামলা হলে তখন সেখানে থাকা কিছু নেতা–কর্মী প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন।
৫ মে বেলা দেড়টার দিকে ঢাকার সব প্রবেশমুখ থেকে হেফাজতের নেতা–কর্মীরা গিয়ে অবস্থান নেন শাপলা চত্বরে। কিন্তু পল্টন মোড় থেকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের চারপাশের রাস্তায় বিভিন্ন ভবনে অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ–সহিংসতা চলতে থাকে। পুলিশও দফায় দফায় গুলি চালায়। রণক্ষেত্রে রূপ নিয়েছিল গোটা ওই এলাকা। দিনের এই সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন হতাহত হন।
তৎপরতা ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনেও
সন্ধ্যায় শাপলা চত্বরে হেফাজতের নেতাদের বক্তব্যে সেখানে অবস্থান করার ঘোষণা আসতে থাকে। সন্ধ্যার পর রাজনৈতিক অঙ্গনেও হেফাজতের এই অবস্থানকে ঘিরে নানামুখী তৎপরতা শুরু হয়। রাত সাড়ে আটটার দিকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামে এক বিবৃতি সংবাদমাধ্যমে পাঠানো হয়। সেই বিবৃতিতে তিনি দলীয় নেতা–কর্মীদের হেফাজতের অবস্থানে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কও হয়েছে। তবে পরে বিএনপির নেতারা হেফাজতের সঙ্গে কোনো যোগসূত্রের অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। সেদিন জামায়াতে ইসলামীও কৌশলে সক্রিয় ছিল।
অন্যদিকে পরিস্থিতি সামলাতে আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চপর্যায়ে ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় আলোচনা করছিলেন।
রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ নিরাপত্তা দিয়ে হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফিকে লালবাগ মাদ্রাসা থেকে নিয়ে শাপলা চত্বরের দিকে রওনা দেয়।
কিন্তু শাপলা চত্বরের দিকে কিছুটা পথ এসে অসুস্থ এবং নিরাপত্তার অভাবের কথা বলে শাহ আহমদ শফি ফিরে যান। তিনি শাপলা চত্বরে আর আসেননি। রাতে অবশ্য জমায়েতও অনেকটা কমে গিয়েছিল।
এরপর রাতে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির অভিযানে হেফাজতের অবস্থান ভেঙে দিয়ে খালি করা হয় শাপলা চত্বর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের দখলে নেওয়ার পর ৬ মে ভোর ৫টায় পুরো মতিঝিল এলাকায় আগের দিনের সহিংস বিক্ষোভের অনেক চিহ্নই ছড়িয়েছিল।
২০১৩ সালের ৫ মের পর হেফাজতের নেতাদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। বিভিন্ন ইসলামপন্থী দলের নেতারা সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিলেন। তাঁরা এই সংগঠনে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলেন। তবে পরে হেফাজতের নেতৃত্ব ও আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে সখ্য গড়ে উঠেছিল। ২০১৮ সালের নভেম্বরে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কওমি মাদ্রাসার ‘শোকরানা মাহফিলে’ হেফাজতের তৎকালীন আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফি ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০১০ সালে যাত্রা শুরু করেছিল হেফাজতে ইসলাম। ২০১১ সালে নারী নীতি প্রণয়নের বিরুদ্ধে হরতাল ডেকেছিল। তবে নারী নীতির বিরোধিতা করাসহ ১৩ দফা দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ মের কর্মসূচি ঘিরেই আলোচনায় আসে হেফাজত।