২০২৪, স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির বছর

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আন্দোলন দমাতে চলছে গুলি। ছাত্র-জনতার লাশ পড়ছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে। এরই মধ্যে নিজ কার্যালয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠকে শেখ হাসিনা বললেন, ‘আন্দোলনের মধ্যে গুজব ছড়ানো হয়েছে, শেখ হাসিনা পালিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বলে দিতে চাই, শেখ হাসিনা পালায়নি, পালায় না।’

২২ জুলাই শেখ হাসিনা এ বক্তব্য দেন। ১৩ দিনের মাথায় তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। যার মধ্য দিয়ে অবসান হয় দেড় দশকের জুলুম-জালিয়াতির শাসন।

ঘটনাবহুল ২০২৪ সালের শুরুতে ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগের দুই নির্বাচনের মতো এটাও ছিল পাতানো নির্বাচন। তবে প্রতিটি নির্বাচনে জেতার পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। ২০১৪ সালে ছিল একতরফা বা বিনা ভোটের নির্বাচন। ২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল আরও জালিয়াতিপূর্ণ; যা ‘রাতের ভোট’ নামে পরিচিতি পায়। ২০২৪ সালে এসে হয় ‘ডামি নির্বাচন’। বিএনপিসহ ছোট-বড় অনেক দলের বর্জনের মুখে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত এই নির্বাচনটিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে আওয়ামী লীগে নিজ দলের ‘ডামি’ প্রার্থী দাঁড় করায়। আওয়ামী লীগ ও ডামি আওয়ামী লীগ (দলের স্বতন্ত্ররা) মিলে ২৮০টি আসন পায়। তার আগে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হামলা, মামলা, গ্রেপ্তার ও সাজা দিয়ে কোণঠাসা করা হয়।

টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রিত্ব কুক্ষিগত করার পর জুলাইয়ের আগপর্যন্ত অর্থনৈতিক সংকট ছাড়া বড় আর কোনো চাপের মুখে পড়তে হয়নি শেখ হাসিনাকে। আগের বছরগুলোতে ব্যাংক খাতসহ বিভিন্ন খাতে লুটপাট, অর্থ পাচার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটসহ বিভিন্ন কারণে ২০২৪ ছিল অর্থনীতির জন্য চরম সংকটের বছর। বছরের শুরু থেকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপে মানুষের নাভিশ্বাস ছিল। এর মধ্যেও ভোটের আগে-পরে ‘অলিগার্ক’ খ্যাত সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা বের করে নিয়ে যান। বিগত সময়ের আর্থিক খাতের এসব অপরাধের জের ও বৈদেশিক ঋণের চাপে দেশের অর্থনীতি এখনো ভুগছে।

২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল আরও জালিয়াতিপূর্ণ; যা ‘রাতের ভোট’ নামে পরিচিতি পায়। ২০২৪ সালে এসে হয় ‘ডামি নির্বাচন’।

রক্তাক্ত জুলাই

সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা প্রজ্ঞাপন ২০২৪ সালের ৫ জুন অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এতে পুনরায় ফিরে আসে কোটা। এর প্রতিবাদে ৬ জুন বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন এবং ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দেন। ১ জুলাই থেকে লাগাতার কর্মসূচি শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। যা পরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রূপ নেয়।

জুলাইয়ের মাঝামাঝি এই ছাত্র আন্দোলন বৃহৎ রূপ ধারণ করতে থাকে। তখন সরকার নানা কৌশলে তা দমনের চেষ্টা করে। এর মধ্যেই শেখ হাসিনার এক বক্তব্য ঘিরে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। তিনি চীন সফর শেষে ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা-সুবিধা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিরা পাবে?’

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবিকে তাচ্ছিল্য করে শেখ হাসিনার দেওয়া এই বক্তব্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। ওই দিন গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ করেন ছাত্রছাত্রীরা। পরদিন শিক্ষার্থীরা আবার বিক্ষোভে নামলে হামলা করে ছাত্রলীগ। সেদিন বহিরাগতদের এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ওপর ন্যক্কারজনক আক্রমণ করে ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ সংগঠন)। এরপর গোয়েন্দাদের দিয়ে ছাত্র সমন্বয়কদের তুলে নিয়ে নির্যাতন করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করা হয়।

১৫ জুলাই আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পরদিন দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৬ জুলাই থেকে পুলিশ গুলি করতে শুরু করে। ওই দিন ঢাকার সায়েন্স ল্যাব ও নিউমার্কেট এলাকায় পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় শিক্ষার্থীদের। সেখানে দুজন মারা যান। তবে ওই দিন রংপুরে আবু সাঈদের মৃত্যু আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক পেতে দাঁড়ান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অকুতোভয় আবু সাঈদ। একের পর এক গুলিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। এ ঘটনার ভিডিও গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন আরও তীব্র হয়।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবিকে তাচ্ছিল্য করে শেখ হাসিনার দেওয়া এই বক্তব্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। ওই দিন গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ করেন ছাত্রছাত্রীরা।

আন্দোলন দমাতে পুলিশের পাশাপাশি নামানো হয় আওয়ামী লীগের সশস্ত্র দলীয় কর্মীদের। ১৯ জুলাই কারফিউ জারি করে সরকার। ওই দিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দেন, ‘শুট অ্যাট সাইট’ (দেখামাত্র গুলি)-এর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এর আগে ১৭ জুলাই বন্ধ করে দেওয়া হয় আন্দোলনের কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর হলগুলো। তখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি মাঠে নামেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর প্রায় প্রতিটি এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নেমেছিলেন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ শ্রমজীবী মানুষ। আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ান শিক্ষক, অভিভাবক ও এলাকাবাসী। আন্দোলনে যুক্ত হন তখনকার বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কর্মীরাও। তখন আন্দোলনটি ছাত্র-জনতার ব্যাপকভিত্তিক গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়।

একপর্যায়ে সরকার কারফিউ জারি করে এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। রাজধানীসহ গুরুত্বপূর্ণ শহর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে বিপুল পরিমাণে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি ও সেনা মোতায়েন করে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্বিচার গুলির মধ্যেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে জেলা-উপজেলা পর্যন্ত। নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচার গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তখন পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত্যুর তথ্য গোপন করছিল।

সম্পদ নাকি মানুষের জীবন; কোনটা মূল্যবান-এ প্রশ্ন তখন সামনে আসে। প্রথম আলোসহ অল্প কিছু গণমাধ্যম ঝুঁকি নিয়ে মানুষের মৃত্যু ও হাসপাতালে আহতদের খবর প্রকাশ শুরু করে। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা দু-একটা হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান।

ঢাকার যাত্রাবাড়ী, রামপুরা-বাড্ডা, উত্তরা, সায়েন্স ল্যাব, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও মহাখালী এলাকা হয়ে উঠেছিল রণক্ষেত্র। আন্দোলন দমনে ব্যবহার করা হয় হেলিকপ্টারও। বেপরোয়া গুলিতে বাসার বারান্দা, ছাদে, শয়নকক্ষে থাকা নারী ও শিশুরাও মারা যায়। যখন একের পর এক মানুষের লাশ পড়ছিল, সরকারপ্রধান তখন বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শনে গিয়ে সেগুলোর ক্ষয়ক্ষতির চিত্র দেখিয়ে উন্নয়ন ধ্বংস হচ্ছে বলে প্রচার করছিল।

সম্পদ নাকি মানুষের জীবন; কোনটা মূল্যবান-এ প্রশ্ন তখন সামনে আসে। প্রথম আলোসহ অল্প কিছু গণমাধ্যম ঝুঁকি নিয়ে মানুষের মৃত্যু ও হাসপাতালে আহতদের খবর প্রকাশ শুরু করে। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা দু-একটা হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান।

পতনের আগের কয়েক দিন সারা দেশে অস্ত্রসহ নতুনভাবে দলীয় কর্মীদের মাঠে নামায় আওয়ামী লীগ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি তারাও নির্বিচার গুলি করে। ওই সময় পুলিশের ঢাকার ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনারের বক্তব্যের একটি ভিডিও চিত্র ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাতে দেখা যায়, ওই কর্মকর্তা আন্দোলনের একটি ভিডিও চিত্র দেখিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলছেন, ‘গুলি করি একটা, একটাই মরে। অন্যগুলো সরে না।’

শেষ মুহূর্তে সেনাবাহিনীকেও ছাত্র-জনতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করেন শেখ হাসিনা। সেনাসদস্যরা ছাত্র-জনতাকে গুলি করতে অস্বীকৃতি জানায়। সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারাও ছাত্র-জনতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে বক্তব্য-বিবৃতি দেন, মিছিল করেন।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে ৩ আগস্ট সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা দিয়ে পরদিন সারা দেশে অসহযোগ কর্মসূচি দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কর্মসূচি ঠেকাতে ৪ আগস্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও ব্যাপকভাবে গুলি চালান। ওই এক দিনেই সারা দেশে শতাধিক মানুষকে হত্যা করে তারা। এ রকম এক উত্তাল পরিস্থিতিতে ঘোষণা আসে ছাত্র-জনতার ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ৬ আগস্টের পরিবর্তে ৫ আগস্ট হবে।

একপর্যায়ে সরকার কারফিউ জারি করে এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। রাজধানীসহ গুরুত্বপূর্ণ শহর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে বিপুল পরিমাণে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি ও সেনা মোতায়েন করে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে।

গণভবন অভিমুখে যাত্রা, পলায়ন

৫ আগস্ট সকাল থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। গাজীপুর-উত্তরা এলাকা থেকে আসতে থাকে বিশাল মিছিল। যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ ও শাহবাগ থেকে আরও মিছিল আসতে থাকে। যা একপর্যায়ে জনস্রোতে পরিণত হয়। সবার গন্তব্য ছিল গণভবন ও জাতীয় সংসদ ভবন।

এই জনস্রোত গণভবনে পৌঁছানোর আগেই শেখ হাসিনা সামরিক বাহিনীর একটি বিমানে করে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে দেশ ছাড়েন। এরপর বিক্ষুব্ধ জনতা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন ও সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে, ভাঙচুর চালায়।

বাংলাদেশের ইতিহাসে রাষ্ট্র ক্ষমতায় একটানা সবচেয়ে বেশি দিন টিকে ছিলেন শেখ হাসিনা। আবার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে পলায়নের ইতিহাসও তিনি তৈরি করলেন। তাঁর পতনের পর জনরোষ থেকে বাঁচতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত সব নেতা-কর্মী, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, দলটির আজ্ঞাবহ সরকারি চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীও একযোগে গা ঢাকা দেন। অনেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পালান। পরবর্তীতে অনেকে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। বিভিন্ন স্থানে বিক্ষুব্ধ মানুষ পুড়িয়ে দেয় থানা, পুলিশের যানবাহনসহ বিভিন্ন স্থাপনা। পুলিশের অনেক সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় আইজিপি থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সবাই আত্মগোপনে চলে যান।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মোট কতজন শহীদ হয়েছেন, সেই হিসাব এখনো পুরোপুরি পাওয়া যায়নি। গণ-অভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সেল গত ২১ ডিসেম্বর প্রাথমিক হিসাবে জানিয়েছে, তখন পর্যন্ত ৮৫৮ জন শহীদ ও সাড়ে ১১ হাজার জন আহত হওয়ার তথ্য পেয়েছিল।

বেরিয়ে এল জুলুম-নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাঁর সময়ের জুলুম-নির্যাতনের ঘটনাগুলো আরও ব্যাপকভাবে সামনে আসতে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম গোপন বন্দিশালা, যেখানে মানুষকে গুম করে দিনের পর দিন আটকে রাখা হতো। ৫ আগস্টের পর ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিতি পাওয়া গোপন বন্দিশালা থেকে ছাড়া পান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহিল আমান আযমী, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত মীর কাশেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাশেম আরমান ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফের নেতা মাইকেল চাকমা। যাঁরা ৫ থেকে ৮ বছর পর্যন্ত গুম ছিলেন।

সরকারের কাছে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দেওয়া অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুম ও গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখার মূল নির্দেশদাতা ছিলেন শেখ হাসিনা। গুম হওয়া অনেক মানুষ এখনো নিখোঁজ। যাঁদের জীবিত থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মনে করছে কমিশন।

বর্ষসেরা বাংলাদেশ, রাজনীতির নতুন অধ্যায়

ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের পতন এবং নতুন যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশকে ২০২৪ সালের বর্ষসেরা দেশ হিসেবে নির্বাচিত করেছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট।

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ যেসব দল গত ১৫ বছর চাপের মুখে ছিল, সেসব দল এখন মুক্ত পরিবেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে। তবে সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচন নাকি নির্বাচনের পরে সংস্কার, সে প্রশ্নে দল, সরকার ও আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। যা ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। পাশাপাশি রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যাদের নেতৃত্বে জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা থেকে দেশ মুক্তি পেয়েছে। তারা ইতিমধ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করে শতাধিক থানায় কমিটি করেছে। তাদের রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়াও চলছে।

কারাদণ্ডে বছর শুরু, শেষে ‘অবাক চিত্র’

২০২৪ সাল শুরু হয়েছিল শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কারাদণ্ডাদেশের মধ্য দিয়ে। বেশ কয়েক বছর ধরে নানাভাবে হেনস্তার পর মুহাম্মদ ইউনূসকে বছরের প্রথম দিন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের এক মামলায় ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেন শ্রম আদালত। যদিও শেখ হাসিনা সরকারের হয়রানিমূলক এ মামলা পরে টেকেনি।

বছরের মাঝামাঝি এসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসান হয়। এরপর ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের বিশেষ অনুরোধে তিনি এই দায়িত্ব নেন। আর তাঁকে যিনি জেলে পুরতে চেয়েছিলেন সেই শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিষয়টি স্মরণ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি দুদিন আগে জেলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আদালতের দরজায় দরজায় ঘুরছিলাম। হঠাৎ করে জেলে না গিয়ে আমি বঙ্গভবনে গিয়ে শপথ গ্রহণ করলাম। একেবারে উল্টো একটা অবাক চিত্র।’

কেবল তা-ই নয়, নতুন সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন এই আদালত। এখন তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করতে দেশে ফেরানোর চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তী সরকার।

২০২৪ সাল কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, সারা বিশ্বের জন্য একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থিত হয়েছে বলে মনে করেন গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাপক দুর্নীতি, লুটপাট ও জুলুমের শাসনের কারণে জনগণের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। সর্বস্তরের মানুষ সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নিয়ে রাস্তায় নামলে স্বৈরশাসক যত শক্তিশালী হোক সে আর টিকতে পারে না, এটা হচ্ছে বড় শিক্ষা। স্বতঃস্ফূর্ত এই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে গণআকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন তৈরি হয়েছে, সেটা বাস্তবায়ন করাটাই হচ্ছে এখন মানুষের প্রত্যাশা। এটাকে উপেক্ষা করা যাবে না।