বিএনপির সঙ্গী জোটগুলোতে মান–অভিমান, অসন্তোষ
বিএনপির নেতৃত্বে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে একাধিক জোট অংশ নিচ্ছে। সমমনা দল মিলে গড়া এসব জোটে ছোট দলের সংখ্যাই বেশি। তবে নেতৃত্বের বিরোধ, কর্মী উপস্থিতি ও জোটের কর্মসূচির মতো বিষয় নিয়ে এসব জোটের দলগুলোর মধ্যে অসন্তোষ ও মনোমালিন্য তৈরি হচ্ছে। এক দলকে নিয়ে জোটের অন্য দলের মধ্যে অস্বস্তির ঘটনাও রয়েছে। সম্প্রতি লেবার পার্টি নামের একটি দল ১২–দলীয় জোট ছেড়েছে। গণ অধিকার পরিষদকে নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ, দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ বেশ কিছু দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে একাধিক জোট। এর মধ্যে রয়েছে সাত দলের গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২-দলীয় জোট ও ১১ দলের জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট। এর বাইরে এলডিপি, জামায়াতে ইসলামী ও গণফোরাম (মন্টু) নিজেদের মতো করে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করছে।
সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের গতি ও ব্যাপ্তি বাড়াতে গত ৯ ডিসেম্বর ২০-দলীয় জোট অনানুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দেয় বিএনপি। ২০-দলীয় জোটে ছিল, এমন ১২টি দল মিলে গঠন করে ‘১২-দলীয় জোট’। গত ২২ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই জোট আত্মপ্রকাশ করে।
গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি পালন শুরু করে ১২-দলীয় জোট। এই জোটের গণমিছিল, গণ–অবস্থান, প্রতিবাদ সমাবেশের মতো সব কর্মসূচিই রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাংকের মোড়ের ফুটপাতে সীমাবদ্ধ ছিল। একই স্থানে ১৮ মার্চ যুগপৎ আন্দোলনের সর্বশেষ কর্মসূচি হিসেবে সমাবেশ করা হয়। এর বাইরে গত তিন মাসে জোটের তেমন কোনো কর্মসূচি ছিল না। বিষয়টি নিয়ে জোটের কয়েকটি দলের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে গঠনের তিন মাসের মাথায় বাংলাদেশ লেবার পার্টি জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে।
১৯ মার্চ বাংলাদেশ লেবার পার্টি ১২-দলীয় জোটের সমন্বয়কারী মোস্তফা জামাল হায়দারকে চিঠি দিয়ে জানায়, গত তিন মাসে জোটের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে জোটের কর্মসূচিতে লেবার পার্টি অংশগ্রহণ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লেবার পার্টি ১২-দলীয় জোটে অন্তর্ভুক্ত থাকবে না। লেবার পার্টি এককভাবে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করবে।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান (ইরান) প্রথম আলোকে বলেন, ১২-দলীয় জোটের কর্মসূচি শুধু বিজয়নগর পানির ট্যাংক এলাকায় সীমাবদ্ধ। ঢাকার বাইরে কোনো কর্মসূচি ছিল না। কার্যক্রমও দিন দিন সীমিত হয়েছে। এতে আন্দোলনের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। তাই লেবার পার্টি এককভাবে কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে ১২-দলীয় জোট সূত্রে জানা যায়, কর্মসূচি নিয়ে অসন্তোষের পাশাপাশি নেতৃত্ব নিয়েও বিরোধ রয়েছে। জোটের অধিকাংশ কর্মসূচি পালিত হয়েছে জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জামাল হায়দার এবং কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বে। বিষয়টি নিয়ে জোটের একাধিক দলের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।
এই বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ১২ দলের জোটে সব দলই সমান হবে। কারও নেতৃত্বে তো জোট হয়নি। নেতৃত্বের কোন্দল বলা যাবে না। তবে ব্যক্তিবিশেষের একচ্ছত্র কর্মকাণ্ড ও পছন্দ দিয়ে জোট পরিচালনা করা হয়েছে।
তবে ১২-দলীয় জোটের সমন্বয়কারী মোস্তফা জামাল হায়দার মনে করেন, শুধু কর্মসূচির কারণে জোট ছাড়েনি লেবার পার্টি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জোট থেকে একটা দল বের হয়ে গেল, এটি দুঃখজনক। আমরা ঐক্য ধরে রাখতে পারিনি। লেবার পার্টির নেতা মোস্তাফিজুর রহমান আগেও তাঁর মূল্যায়ন পাচ্ছেন না বলে কথা তুলেছিলেন। এটাই প্রধান কারণ বলে মনে করি। তবে আমরা চেষ্টা করেছি যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে।’
গণ অধিকারকে নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চে অস্বস্তি
গত বছরের ৮ আগস্ট সাতটি দল ও সংগঠন নিয়ে গঠিত হয় গণতন্ত্র মঞ্চ। গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ কর্মসূচি পালন শুরু করে গণতন্ত্র মঞ্চ। প্রথম কর্মসূচি থেকেই গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে গণ অধিকার পরিষদের মনোমালিন্য দৃশ্যমান হয়। ৩০ ডিসেম্বরের কর্মসূচিতে গণ অধিকার পরিষদ অংশ নেয়নি। দলগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৬ জানুয়ারির বিক্ষোভ সমাবেশেও অংশ নেয়নি গণ অধিকার পরিষদ। এ ক্ষেত্রে দলটি যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচিতে তাদের দলের নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ণ না করার অভিযোগ তুলেছিল।
অবশ্য পরে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচিতে যোগ দেয় গণ অধিকার পরিষদ। গত ২৫ জানুয়ারি এবং এর পরের প্রায় সব কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক। কিন্তু এসব কর্মসূচিতে গণ অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি ছিল একেবারেই সীমিত। মূলত স্বল্পসংখ্যক কর্মী নিয়ে নুরুল হক এসব কর্মসূচিতে অংশ নেন।
গণতন্ত্র মঞ্চের দুজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা বলেন, গণ অধিকার পরিষদকে নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যান্য দলের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে। গণ অধিকার পরিষদের নেতাদের আচরণ, কথাবার্তা, বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁদের যোগাযোগ নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে দূরত্ব রয়েছে। গণতন্ত্র মঞ্চের গত ১০টি কর্মসূচিতে সবচেয়ে কম লোকবল এনেছে গণ অধিকার পরিষদ।
গণতন্ত্র মঞ্চের একজন নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চের কর্মসূচিতে গণ অধিকার পরিষদ ‘টোকেন পার্টিসিপেশন’ (সৌজন্যমূলক অংশগ্রহণ) করে। গণ অধিকার পরিষদের কর্মকাণ্ড নিয়ে মঞ্চের বাকিরা এখনো নিশ্চিত নয়। গণ অধিকার পরিষদকে শেষ পর্যন্ত জোটে ধরে রাখা যাবে কি না, সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
গণ অধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শুরুর দিকে মঞ্চের বিভিন্ন কর্মসূচিতে গণ অধিকার পরিষদের জনবলই বেশি থাকত। অথচ তাঁদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হতো না। বিষয়টি নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্য দলগুলোর সঙ্গে গণ অধিকার পরিষদের মনোমালিন্য হয়। যুগপৎ কর্মসূচি পালনের শুরুর দিকে জোটে ভাঙনের শঙ্কাও তৈরি হয়েছিল।
এ বিষয়ে গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘একসঙ্গে চলতে গেলে মতপার্থক্য হতে পারে। জোট গঠনের পর গণ অধিকার পরিষদের প্রতি মঞ্চের অন্যান্য দলের মনোভাব আমাদের নেতা-কর্মীদের হতাশ করে। বিষয়টি নিয়ে জোটে খোলামেলা আলোচনা হয়।’ নুরুল হক বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চের কর্মসূচিতে অন্যান্য দলের তুলনায় গণ অধিকার পরিষদের উপস্থিতি ভালো। যারা কর্মসূচিতে লোকবল আনতে পারে, তাদের তো ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। যুগপৎ আন্দোলন সফল করতে গণ অধিকার পরিষদ সক্রিয় রয়েছে।
যদিও গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে জোটের বাকিদের দূরত্ব আগের চেয়ে কমেছে। তবে এই দলের বিষয়ে এখনো আস্থা রাখতে পারছেন না গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতারা।