জিরো পয়েন্টে দিনভর বিক্ষোভ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা গণজমায়েত মঞ্চে ছাত্র প্রতিনিধিরা। গতকাল বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে শহীদ নূর হোসেন দিবসে গতকাল রোববার ঢাকায় দিনভর ছিল উত্তেজনা। রাজধানীর গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েও সেখানে যেতে পারেনি দলটি। তাদের কর্মসূচি প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে সেখানে একদিকে গণজমায়েত কর্মসূচি পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, অন্যদিকে বিক্ষোভ দেখিয়েছে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন।

জিরো পয়েন্টের কাছে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের সামনে ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ মঞ্চের ব্যানারে অবস্থান নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারা গতকাল সেখানে প্রায় সারা দিন গণজমায়েত কর্মসূচি পালন করে। পাশাপাশি জিরো পয়েন্ট থেকে অল্প দূরত্বেই আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন শাহবাগ ও পল্টন থানা যুবদলের নেতা-কর্মীরা। রাশেদ খানের নেতৃত্বে গণ অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনকে সেখানে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে।

এ প্রেক্ষাপটে গতকাল জিরো পয়েন্ট ও আশপাশের এলাকায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। ওই এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী সন্দেহে ৪০ জনের বেশি ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশ। তবে বিক্ষোভকারীরা তাঁদের কাউকে কাউকে মারধর করার পর পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছেন।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে ঢাকার মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর কিছু নেতা-কর্মী ঝটিকা মিছিল করেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।

গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে গোলচত্বরের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ নূর হোসেনের নামে। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নূর হোসেন বুক ও পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে রাজপথে মিছিলে নেমেছিলেন। সেদিন পুলিশের গুলিতে তিনি মারা যান। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার

পর আওয়ামী লীগ এই প্রথম কোনো কর্মসূচি নিয়েছিল নূর হোসেনকে হত্যার দিনটিতে। দলটি সেখানে কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন জিরো পয়েন্টে ফুল দিয়ে নূর হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে।

এক ব্যক্তিকে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। গতকাল জিরো পয়েন্ট এলাকায়
ছবি: সাজিদ হোসেন

পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে জিরো পয়েন্ট ও আশপাশের এলাকায় ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা। কারও গতিবিধি সন্দেহজনক হলেই পুলিশকে তল্লাশি করতে দেখা গেছে। গোটা ওই এলাকায় গতকাল দিনভর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) টহল ছিল।

এ ছাড়া ঢাকার প্রধান চারটি প্রবেশমুখসহ বিভিন্ন স্থানে গতকাল সন্দেহভাজনদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তল্লাশি করতেও দেখা গেছে। বিশেষ করে সাভার উপজেলার আমিনবাজার ও আশুলিয়া এলাকায় মহাসড়কে তল্লাশিচৌকি বসিয়ে তল্লাশি চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তল্লাশি চলাকালে সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি বলে জানিয়েছেন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সার্কেল) মো. শাহীনুর কবির।

এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, নূর হোসেন দিবসকে কেন্দ্র করে কেউ যেন বিশৃঙ্খলা করতে না পারে, সে জন্য ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অতিরিক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।

‘আওয়ামী লীগের জনসমক্ষে আসার অধিকার নেই’

গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে নূর হোসেন চত্বর থেকে ১০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটের অবস্থান। আওয়ামী লীগের কর্মসূচি প্রতিহত করতে গতকাল সেখানে সড়কের এক পাশ বন্ধ করে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারা সেখানে ‘ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ মঞ্চের’ ব্যানারে গণজমায়েত কর্মসূচি পালন করে। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল সোয়া ৪টা পর্যন্ত চলা এই কর্মসূচিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগে বিচারের দাবি জানানো হয়। সেখানে বক্তব্য দেন জুলাই–আগস্ট আন্দোলনে আহত ব্যক্তি, আহতদের স্বজন ও ছাত্রনেতারা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের জনসমক্ষে আসার অধিকার নেই। আওয়ামী লীগ নাৎসি বাহিনীর চেয়েও নৃশংস। আওয়ামী লীগকে যারা পুনর্বাসনের চেষ্টা করবে, তাদেরও প্রতিহত করা হবে।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেন, শুধু ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়ামী লীগ দুই হাজারের মতো মানুষ হত্যা করেছে। অর্ধলাখ মানুষকে আহত করেছে। শেখ হাসিনা প্রতিটি হত্যার হুকুমদাতা, ফলে তাঁর বিচার হওয়া উচিত।

গণজমায়েতে আরও বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব আরিফ সোহেল, মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ, মুখপাত্র উমামা ফাতেমা, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব ফজলুল করিম কাসেমী, মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী, ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফুল ইসলাম হাদী, ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আরমানুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবু সাদিক কায়েম প্রমুখ।

সন্দেহ হলেই মারধর, পুলিশে সোপর্দ

গতকাল সকাল থেকেই নূর হোসেন চত্বরে উৎসুক জনতার ভিড় ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পল্টন ও শাহবাগ থানা যুবদলের নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। সকাল ১০টার পর স্থানীয় যুবদলের নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন।

যুবদলের নেতা-কর্মীরা যখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করছিলেন, তখন সেখানে এসে আওয়ামী লীগের সমর্থনে কথা বলার কারণে মারধরের শিকার হয়েছেন এক নারীসহ বেশ কয়েকজন। ‘শেখ হাসিনা আবার ফিরে আসবেন’—এমন কথা বলার কারণে দুপুরে একজন প্রবীণ ব্যক্তিকে মারধরের শিকার হতে দেখা গেছে। এ ছাড়া যাঁরা মারধরের শিকার হয়েছেন, তাঁদের কারও কারও পোশাক ছিঁড়ে ফেলতেও দেখা যায়। পরে তাঁদের পুলিশে সোপর্দ করা হয়।

বেলা একটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত জিরো পয়েন্টের আশপাশের এলাকা থেকেও আওয়ামী লীগ সমর্থক সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করতে দেখা গেছে। আটক ব্যক্তিদের মারধরও করতে দেখা গেছে সেখানে বিভিন্ন সংগঠনের বিক্ষোভকারীদের। এর মধ্যে বিকেল চারটার দিকে এক যুবক জিরো পয়েন্টের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মারধরের পর যুবলীগের রাজনীতি করেন এমন স্বীকারোক্তি দিলে তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে দেখা গেছে। এ ছাড়া বেলা দুইটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বেশ কয়েকবার লাঠিসোঁটা হাতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী সন্দেহে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ধাওয়া দিতে দেখা গেছে।

জেলায় জেলায় কর্মসূচি

নূর হোসেন চত্বরে আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ কর্মসূচি ডাকার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন মহানগর ও জেলায় গতকাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল দুপুর ১২টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত রাজশাহী নগরের সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে আয়োজিত কর্মসূচিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বক্তব্য দেন।

প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে জানা গেছে, রংপুরের লালবাগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ব্যানারে গতকাল বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়। বরিশালে আলাদাভাবে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ কর্মসূচিকে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে সিলেট নগরের বিভিন্ন মোড়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার ধামরাইয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা]