দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চলতি বছরের জুনের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন চূড়ান্ত করার কথা বলেছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এটি তাদের কর্মপরিকল্পনায় ছিল। তবে এ ক্ষেত্রে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শেষ করতে পারছে না ইসি।
আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের শেষে বা আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম দিকে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে—এমন ধারণা ইসি থেকে পাওয়া গেছে। এই নির্বাচন সামনে রেখে গত বছরের সেপ্টেম্বরে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল ইসি।
নতুন দলের নিবন্ধন দেওয়ার পাশাপাশি কর্মপরিকল্পনায় বর্তমানে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো নিবন্ধনের শর্ত মেনে চলছে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখবে বলে ঘোষণা করেছিল ইসি। কিন্তু ইতিমধ্যে তারা এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো নিবন্ধনের শর্ত মেনে চলছে কি না, জাতীয় নির্বাচনের আগে সেটি যাচাই করতে গেলে বিতর্ক তৈরি হতে পারে—এমন আশঙ্কা থেকে নিবন্ধিত দলের শর্ত মেনে চলার বিষয় যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত থেকে গত এপ্রিলে সরে আসে ইসি। এখন নতুন দলের নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রেও ইসি পিছিয়ে পড়েছে।
ইসি তাদের কর্মপরিকল্পনায় বলেছিল, চলতি বছরের মে মাসে নতুন নিবন্ধনের জন্য পাওয়া আবেদন যাচাই–বাছাই করে নিবন্ধন দেবে। আর জুন মাসে নতুন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করবে। তবে ইসি সূত্র জানায়, জুন শেষ হতে চললেও এখন পর্যন্ত নতুন নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা দলগুলোর মাঠপর্যায়ের তথ্য যাচাই–বাছাইয়ের কাজই শেষ করতে পারেনি।
গত বছরের অক্টোবরে নতুন নিবন্ধনের জন্য আবেদনের নির্ধারিত সময়ে মোট ৯৩টি দল ইসির নিবন্ধন পেতে আবেদন করেছিল। এর মধ্যে প্রাথমিক বাছাইয়ে ১২টি দলের কাগজপত্র সঠিক পায় ইসি। গত এপ্রিলে এই ১২ দলের দেওয়া মাঠপর্যায়ের তথ্য যাচাইয়ের কাজ শুরু করেন ইসির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা। ইসি সূত্র জানায়, মাঠ থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে গত সপ্তাহে বৈঠক করে ইসি।
কিন্তু সেখানে কোনো দলকে নিবন্ধন দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। কমিশন এসব তথ্য আরও খতিয়ে দেখতে বলেছে। এ জন্য একাধিক উপকমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। এসব কমিটি দলগুলোর দেওয়া তথ্য কিছু দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে আবার যাচাই করে দেখবে। এরপর আবার এসব তথ্য কমিশনের সভায় উপস্থাপন করা হবে। তারপর কমিশন নতুন দলের নিবন্ধনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে। আগামী মাসের আগে কাজটি শেষ করা সম্ভব হবে না।
নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. জাহাংগীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, জুনের মধ্যে নতুন দলের নিবন্ধনের কাজ শেষ হবে না। মাঠপর্যায়ের কাজ কবে শেষ হবে তার সুনির্দিষ্ট তারিখ বলা যাবে না। তবে তাঁরা যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করার চেষ্টা করছেন।
এখন যেসব দল ইসিতে নিবন্ধিত, তার অনেক কটিই নামসর্বস্ব। আবার বড় দলগুলোও গঠনতন্ত্রের ঘোষণা যথাযথভাবে পালন করছে না। আইন অনুযায়ী ছাত্রসংগঠন, শ্রমিক সংগঠনকে সহযোগী সংগঠন হিসেবে রাখা যায় না।
নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত আসতে দেরি হলে নতুন দলের জন্য কোনো সমস্যা হবে কি না, তারা নির্বাচনের জন্য সময় কম পাবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন না এতে কোনো সমস্যা হবে। কারণ, দলগুলো এখনই আছে। নিবন্ধন পেলে তারা দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে।
নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক বাছাইয়ে যে ১২টি দল টিকেছে, সেগুলো হলো এবি পার্টি (আমার বাংলাদেশ পার্টি), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), বাংলাদেশ হিউম্যানিস্ট পার্টি (বিএইচপি), গণ অধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ সনাতন পার্টি, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি), বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি (বিএমজেপি), বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি), ডেমোক্রেটিক পার্টি ও বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএলডিপি)।
জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব (আরপিও) আদেশ অনুযায়ী, কোনো দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত না হলে তারা দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না। আরপিও এবং রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা অনুযায়ী তিনটি শর্তের যেকোনো একটি পূরণ করলে কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। শর্ত তিনটি হলো প্রথমত, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে অনুষ্ঠিত যেকোনো সংসদ নির্বাচনের যেকোনো একটিতে দলীয় প্রতীকে একটি আসন পেতে হবে। দ্বিতীয়ত, কোনো সংসদ নির্বাচনে দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচনী এলাকায় মোট প্রদত্ত ভোটের ৫ শতাংশ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
ইসি সূত্র জানায়, আইনে থাকলেও মূলত প্রথম দুটি শর্ত নতুন দলের নিবন্ধনের ক্ষেত্রে এখন সেভাবে কার্যকর নয়। এখন মূলত তৃতীয় শর্তটি দেখা হয়। কার্যালয়, কমিটি ও ভোটার–সংক্রান্ত যেসব তথ্য দলগুলো দিয়েছে, মূলত সেগুলোই মাঠপর্যায়ে যাচাইয়ের কাজ করছেন ইসির কর্মকর্তারা।
তৃতীয়ত, দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং দেশের এক-তৃতীয়াংশ জেলায় কার্যকর জেলা কার্যালয় ও ১০০টি উপজেলায় বা মেট্রোপলিটন থানায় কার্যালয় থাকতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় দলের সদস্য হিসেবে ন্যূনতম ২০০ ভোটার তালিকাভুক্ত থাকতে হবে। এর বাইরে দলের গঠনতন্ত্রে আরও কিছু বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকতে হয়।
ইসি সূত্র জানায়, আইনে থাকলেও মূলত প্রথম দুটি শর্ত নতুন দলের নিবন্ধনের ক্ষেত্রে এখন সেভাবে কার্যকর নয়। এখন মূলত তৃতীয় শর্তটি দেখা হয়। কার্যালয়, কমিটি ও ভোটার–সংক্রান্ত যেসব তথ্য দলগুলো দিয়েছে, মূলত সেগুলোই মাঠপর্যায়ে যাচাইয়ের কাজ করছেন ইসির কর্মকর্তারা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, এখন যেসব দল ইসিতে নিবন্ধিত, তার অনেক কটিই নামসর্বস্ব। আবার বড় দলগুলোও গঠনতন্ত্রের ঘোষণা যথাযথভাবে পালন করছে না। আইন অনুযায়ী ছাত্রসংগঠন, শ্রমিক সংগঠনকে সহযোগী সংগঠন হিসেবে রাখা যায় না। প্রবাসে দলের শাখা করা যায় না; কিন্তু দলগুলো নানা কৌশলে এই কাজগুলো করছে। ইসির উচিত নিবন্ধিত দলগুলো শর্ত পালন করছে কি না, খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া।
একই সঙ্গে বদিউল আলম মজুমদার উল্লেখ করেন, নির্বাচন কমিশন যে নিজেদের নির্ধারণ করা সময়ের মধ্যে নতুন দলের নিবন্ধন দিতে পারছে না, সেটি গ্রহণযোগ্য নয়।