বিশেষ সাক্ষাৎকার: শেষ পর্ব

ভোটে জিতলে জাতীয় সরকার গঠন করবে বিএনপি

বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হলে জাতীয় সরকার গঠন করতে চায়। এ নিয়ে তাদের ভাবনা, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ও চলমান রাজনীতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ঢাকার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কাদির কল্লোল ও সেলিম জাহিদ। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রকাশিত হলো শেষ পর্ব।

প্রথম আলো:

নির্বাচনে জয়ী হলে জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলছেন। জাতীয় সরকার আসলে কী, এর ধারণাটা কী?

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর: এর ধারণাটা হচ্ছে, আপনি এখনো আন্দোলন করছেন, এরপর আপনি নির্বাচন করলেন। নির্বাচন করে ওখানে ১০টি দল জিতল। ৫ জন, ১০ জন, ১৫ জন, যা নিয়ে হোক জিতল। তাদের নিয়ে আমরা একটা জাতীয় সরকার করব। আমাদের কিন্তু পরিষ্কার বলা আছে, ৩১ দফা বাস্তবায়ন করতে চাই এই কনসেপ্টের ভিত্তিতে; যেখানে এই দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় সরকার করা হবে।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

তাহলে কি কোনো বিরোধী দল থাকবে না?

মির্জা ফখরুল: বিরোধী দল থাকবে না কেন। আওয়ামী লীগকে তো আমরা নেব না। জাতীয় সরকারে আওয়ামী লীগ থাকবে না, এটা তো আমাদের ঘোষণা।

প্রথম আলো:

জামায়াতে ইসলামী কি থাকবে?

মির্জা ফখরুল: জামায়াত যদি থাকে, থাকবে। কিন্তু জাতীয় সরকারে নেব কি না, এটা আমাদের এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

প্রথম আলো:

জাতীয় সরকার গঠনের কথা যেহেতু বলছেন, সে ক্ষেত্রে এবার নির্বাচন বিএনপি দলগতভাবে নাকি জোটবদ্ধ হয়ে করবে?

মির্জা ফখরুল: এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, এটা করার সময়ও আসেনি। নির্বাচনেরই ঠিক নেই, আমি এখনই জোটের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব কেন।

প্রথম আলো:

বিএনপিকে নিয়ে মানুষের একটা ভয় আছে। ২০০১ সাল থেকে বিএনপির পাঁচ বছরের শাসনে জঙ্গি তৎপরতা, গ্রেনেড হামলা, দুর্নীতিতে চারবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া—এ বিষয়গুলো আছে।

মির্জা ফখরুল: বিএনপি তো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। বিএনপির যে রাজনৈতিক চরিত্র, এটা তো এই দেশেরই একটা। বিএনপি একটি মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল, এখানে সব ধরনের লোক আছে। কিন্তু বিএনপির বিরুদ্ধে দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটা পরিকল্পিত প্রচার আছে যে বিএনপি জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছে, বিএনপি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে। আওয়ামী লীগ যে দুর্নীতি করেছে গত ১৫ বছরে, তার আশপাশেও কি বিএনপির দুর্নীতি ধরতে পারবেন? কিছুই পারবেন না। অথচ সে বিষয়ে একটা কথাও বলেনি গণমাধ্যম। আবার পুরোনো বিষয় নিয়ে আসছেন কেন, এখনকার কথায় আসেন যে আমরা কী করতে পারি। সরকারে যদি আসতে পারি, তখন দেখেন।

প্রথম আলো:

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক জায়গায় ইতিমধ্যে বিএনপির বিরুদ্ধে দখল, চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে।

মির্জা ফখরুল: দখলের বিষয়টা আমি বলি, বিএনপি হিসেবে কোনো দখল, চাঁদাবাজি হচ্ছে না। আমরা দলের পক্ষ থেকে অত্যন্ত শক্ত অবস্থান নিয়েছি। আমরা এতটুকু কোনো অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন (ব্যবস্থা) নিয়েছি। আমরা ঢাকা সিটির উত্তরের কমিটিও বাতিল করেছি। কেন করেছি, নিশ্চয়ই অভিযোগ আছে। এ কাজগুলো তো আমরা করছি। সেটাকে কিন্তু আপনারা হাইলাইট করছেন না। বিএনপির লোকেরা কোনো দুর্নীতি করে না, করছে কিছু দুর্বৃত্ত। ওদের আমরা বিএনপির লোক মনে করি না। তারা সবাই দুর্বৃত্ত, সবাই বাজে লোক।

প্রথম আলো:

সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে, বিভিন্ন জায়গায় এখন যেসব মামলা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে বিএনপি আসামি ঠিক করে দিচ্ছে। এটা কি দলগত অবস্থান থেকে করা হচ্ছে?

মির্জা ফখরুল: না। আমাদের দলগত কোনো অবস্থান নেই। মামলার ব্যাপারে আমাদের প্রকাশ্য অবস্থান যে যাঁরা ভুক্তভোগী, তাঁরা মামলা করবেন। তাঁদের আমরা সহযোগিতা করব। সরকার অর্থাৎ পুলিশ বাদী হয়ে যদি মামলা করে, সহায়তা করব। আমরা বিএনপির তরফ থেকে কোনো মামলা করছি না।

প্রথম আলো:

পটপরিবর্তনের পর জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির টানাপোড়েনের বিষয় নতুন করে সামনে এসেছে। কৌশলগত, নাকি আদর্শিক কারণে এই দূরত্ব?

মির্জা ফখরুল: দুঃখজনকভাবে বলব, বাংলাদেশের গণমাধ্যম এই বিষয়টিকে সব সময় ভিন্নভাবে দেখিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আমাদের আদর্শিক মিল কখনোই ছিল না বা প্রশ্নই ওঠে না। জামায়াতের সঙ্গে আমাদের যতটুকু জোট ছিল, এটা ছিল আন্দোলন এবং নির্বাচনী জোট। এটা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে পরিবর্তন হতে পারে। জামায়াতের সঙ্গে আমি মনে করি কোনো দূরত্ব নেই। আমাকে দেখেছেন কি জামায়াতের বিরুদ্ধে কোথাও কোনো বিবৃতি দিয়েছি, কথা বলেছি? আমরা বলিনি, এটা বলছি না আমরা। আগেও আমরা জামায়াতের পক্ষেও খুব একটা কথা বলিনি। আর গত কয়েক বছরে জোটই তো ছিল না। আমরা জোট ভেঙে দিয়েছি বহু আগে। আমরা যুগপৎ আন্দোলন করেছি সমমনা দলগুলোর সঙ্গে। এবং সে রকম একটা দল (জামায়াত) যারা নিজেরাই আন্দোলন করেছে।

প্রথম আলো:

কিন্তু সম্প্রতি জামায়াতের আমির বলেছেন, বিএনপি তো ইতিমধ্যে ক্ষমতায় এসেই গেছে। ক্ষমতার ৮০ ভাগ দখল করেই ফেলেছে। ভিক্ষুকের থালা থেকে হাটবাজার কিছুই বাকি রাখেনি।

মির্জা ফখরুল: এ ধরনের বক্তব্য যদি উনি দিয়ে থাকেন, আমি জানি না যে উনি ঠিক কী বলেছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে উনি অরাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন। এবং এখন উনারা বলছেন যে জাতীয় ঐক্য, জাতীয় ঐক্য—ওই বক্তব্য জাতীয় ঐক্যের পক্ষে যায় না। এখন তো উনারা ওই জায়গা থেকে সরে এসেছেন। এখনো আমরা দেখছি, উনারা জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন।

প্রথম আলো:

দীর্ঘদিন ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক একটা দৃশ্যমান বৈরী জায়গায় ছিল। সম্প্রতি আপনি বলেছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে বরফ গলতে শুরু করেছে। কেন?

মির্জা ফখরুল: আমি এই পরিপ্রেক্ষিতেই বলেছি যে ভারতের হাইকমিশনার (প্রণয় কুমার ভার্মা) যখন আমাদের অফিসে এসেছেন। এর আগে বহু বছর তাঁরা আসেননি। তাঁরা যখন আমাদের এখানে এসেছেন, এটা আমি মনে করি, তাঁদের যে দৃষ্টিভঙ্গি বিএনপিকে নিয়ে, সেই জায়গায় নিশ্চয়ই কোনো পরিবর্তন এসেছে। না হলে আমাদের এখানে এসে কথা বলার কথা নয়। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলেছি যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বরফ গলতে শুরু করেছে। এটাই হওয়া উচিত।

ভারতের সঙ্গে শুধু বিএনপির নয়, বাংলাদেশের সবার একটা সম্পর্ক রাখা উচিত এ জন্য যে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী। দুই নম্বর হচ্ছে, আমাদের বহু বিষয়ে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য আছে। খাদ্যশস্যের ব্যাপারে, চাল, ডাল, আদা, মসলা আমরা আমদানি করি ভারত থেকে। ইদানীং কয়লা আনা হচ্ছে, বেশ কিছু প্রজেক্ট আছে, সুতরাং ভারতের সঙ্গে আমরা সম্পর্ক রাখব না, কথা বলব না, এটা তো রাজনীতি হতে পারে না।

প্রথম আলো:

এখন তাদের সঙ্গে আপনাদের বোঝাপড়াটা কোন পর্যায়ে।

মির্জা ফখরুল: কোন পর্যায়ে বলা মুশকিল। তবে আমরা এখন কথা বলার পর্যায়ে তো এসেছি।

প্রথম আলো:

এ ক্ষেত্রে কি কোনো শর্ত আসছে?

মির্জা ফখরুল: না। আমাদের সঙ্গে কখনোই তারা শর্ত দেয়নি, এখনো কোনো শর্ত নেই। এখানে যেটা আমি মনে করি, এ ক্ষেত্রে যে তারা এগিয়ে এসেছে, এটাকে আমি ইতিবাচক মনে করি। আমাদেরও উচিত হবে এই স্টেপটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আপনি তাদের রাজনীতির সঙ্গে একমত না–ও হতে পারেন, কিন্তু এনগেজ তো (যুক্ত করা) করতে পারেন। আজকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ হচ্ছে, কিন্তু তৃতীয় পক্ষ দিয়ে তারা কথা বলছে না? ইসরায়েল ও গাজায় যে যুদ্ধ, সেখানে তৃতীয় পক্ষ কথা বলছে না? এটাই বাস্তবতা। তাদের (ভারত) অবজ্ঞা করে বাংলাদেশে আপনি রাজনীতি করবেন, এটা পপুলিস্ট পার্টি করতে পারে, কিন্তু বাস্তব রাজনীতি করতে গেলে ভারতকে একেবারে এড়ানোর সুযোগ আছে বলে মনে করি না।

প্রথম আলো:

এটা নষ্ট হলো কেন?

মির্জা ফখরুল: এটা আপনার বিভিন্ন কারণে ভারতের যে অনাস্থা, তাদের যে ভুল, আমি ভুল বলব। একটি মাত্র দলের ওপর সমর্থন, সব ডিম একটা ঝুড়িতে রাখা। আওয়ামী লীগ, আর কেউ নেই। ফলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ভারতের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এবং অ্যাসেসমেন্টটা যে ভুল, তারা মনে করেছে আওয়ামী লীগের মতো পপুলার পার্টি থাকলে তাদের সমস্যাগুলোর সমাধান হবে। হয়েছেও কিছু কিছু। কিন্তু সেই বিষয়গুলো যদি বিএনপির মতো জনপ্রিয় দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে না হয়, তাহলে ভুল–বোঝাবুঝি হবেই।

প্রথম আলো:

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন?

মির্জা ফখরুল: যত দ্রুত সম্ভব, মামলা-মোকদ্দমাগুলো একটা পর্যায়ে এলে তিনি দেশে আসবেন।

প্রথম আলো:

তাঁর মামলা ও দেশে ফেরা নিয়ে সরকারের সঙ্গে আপনাদের কি কোনো আলোচনা চলছে?

মির্জা ফখরুল: হ্যাঁ, আমরা সরকারকে বলেছি, দ্রুত তাঁর সব মামলা তুলতে হবে। ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) বিরুদ্ধে এখনো তো মামলা আছে।

প্রথম আলো:

সুনির্দিষ্ট করে কোনো মামলার কথা উল্লেখ করছেন?

মির্জা ফখরুল: সুনির্দিষ্ট করে বলতে হবে কেন? হাজার হাজার মামলা, ১ লাখ ৪৫ হাজার মামলা। উনাদের একটা সামগ্রিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেসব দল আন্দোলন করেছে, তাদের সব মামলা তাঁরা প্রত্যাহার করবেন। দ্যাট শুড বি দ্য স্পিরিট। আপনি (সরকার) একটা আদেশ জারি করবেন, যে আদেশের মধ্যে এত সাল থেকে এত সাল পর্যন্ত দলগুলোর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কারণে যে হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে, সব মামলা প্রত্যাহার করা হলো।

প্রথম আলো:

আপনাদের তরফ থেকে কোনো সময়সীমা?

মির্জা ফখরুল: এখানে সময়সীমার প্রশ্ন নেই তো। শোনেন, তারেক রহমান যদি দেশে আসতে চান, কালকেই আসতে পারেন। কিন্তু আমরা চাচ্ছি না তারেক সাহেব এমনি এমনি দেশে চলে আসুক। উনার আইনগত দিক শেষ করে আসাটা ঠিক হবে বলে আমরা মনে করি।

প্রথম আলো:

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কি রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন?

মির্জা ফখরুল: এটা এখনই বলা যাবে না। কারণ, উনি তো প্রচণ্ড অসুস্থ। উনি যদি নিজেকে ফিট মনে করেন, অথবা চিকিৎসকেরা যদি বলেন যে হ্যাঁ, ওনার সে অবস্থা আছে, তাহলে অবশ্যই তিনি আসবেন।

প্রথম আলো:

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মানুষ চায়, বিএনপি পরিশুদ্ধ হয়ে আসুক। জামায়াত তার ঐতিহাসিক দায়ভার আর ফ্যাসিবাদী প্রবণতা ফেলে আসুক। আওয়ামী লীগও বিচার ও রিডেম্পশনের (দায়মোচন) পর তার উগ্র ফ্যাসিবাদ বা মুজিববাদ পরিত্যাগ করুক। এ ব্যাপারে কী বলবেন?

মির্জা ফখরুল: মাহফুজ আলমের আবির্ভাব সম্পূর্ণ নতুন, একটা ক্রান্তিকালে এসেছেন। সুতরাং তিনি বক্তব্য রাখতেই পারেন। কিন্তু সেই বক্তব্য শালীনতার সঙ্গে যেন হয়, সেটাই প্রত্যাশা। বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল। ১৬ বছর ধরে আমরা স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। এর আগে নব্বইয়ে ৯ বছর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করেছি। কোনো ভুলত্রুটি থাকলে সেটা জনগণ বিচার করবে।

প্রথম আলো:

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

মির্জা ফখরুল: আপনাদেরও ধন্যবাদ।

(শেষ)