জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় কমিশন করছে সরকার

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় মহান বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেনছবি: পিআইডি

মহান বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় নতুন একটি কমিশন গঠন করার কথা জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হচ্ছে সরকার। এই কমিশনের কাজ হবে রাজনৈতিক দলসহ সব পক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করা। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপন হবে, সেগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি তা বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করবে ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর প্রথম বিজয় দিবসে গতকাল সোমবার সকাল ১০টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর ভাষণে আগামী জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়, গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন ও শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনের তথ্য, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও চলমান সংস্কার প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে।

ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, যেকোনো সংস্কারের কাজে হাত দিতে গেলে রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন হয়। অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম পর্যায়ে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশন শিগগিরই প্রতিবেদন পেশ করবে বলে তিনি আশা করছেন। এই ছয় কমিশনের চেয়ারম্যানদের নিয়ে ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ করার দিকে অন্তর্বর্তী সরকার অগ্রসর হচ্ছে বলে জানান তিনি।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভাষণে বলেছেন, তিনি নিজেই ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’–এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি বলেন, ‘যেহেতু জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা অন্তর্বর্তী সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, তা বিবেচনা করে আমি এই কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করব। আমার সঙ্গে এই কমিশনের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ (সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান)। কমিশন প্রয়োজন মনে করলে নতুন সদস্য কো-অপ্ট (যুক্ত করা) করতে পারবে। প্রথম এই ছয়টি কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাবার পর আগামী মাসেই জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশনের কাজ শুরু করতে পারবে বলে আমি আশা করছি।’

ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, নতুন এই কমিশনের প্রথম কাজ হবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেসব সিদ্ধান্ত জরুরি, সেসব বিষয়ে তাড়াতাড়ি ঐকমত্য সৃষ্টি করা এবং সবার সঙ্গে আলোচনা করে কোন সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যায়, সে ব্যাপারে পরামর্শ চূড়ান্ত করা।

নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়

জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।’

নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘প্রধান সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন করার ব্যাপারে বারবার আপনাদের কাছে আবেদন জানিয়ে এসেছি। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে আমাদেরকে যদি, আবার বলছি “যদি”, অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচনপ্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি, তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে।’

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা সবচেয়ে বড় কাজ। এখন এই কাজ আরও কঠিন এ জন্য যে গত তিনটি নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ করার সুযোগ ছিল না। ভোটার তালিকা যাচাই করার সুযোগ হয়নি কারও। গত ১৫ বছরে যাঁরা ভোটার হয়েছেন, তাঁদের সবার নাম ভোটার তালিকায় তোলা নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর এখানে গলদ রাখার কোনো সুযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাঁর একান্ত ইচ্ছা, এবারের নির্বাচনে তরুণ–তরুণীদের (প্রথম ভোটার হওয়া) শতকরা ১০০ ভাগের কাছাকাছি সংখ্যায় ভোট দিয়ে একটি ঐতিহ্য সৃষ্টি করুক। একই সঙ্গে তিনি বলেন, প্রথমবারের মতো প্রবাসীরাও যাতে নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন, তা বর্তমান সরকার নিশ্চিত করতে চায়। এ জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তাঁদের ভয় কিছুতেই কাটছে না

গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘এটা একটা লোমহর্ষক প্রতিবেদন। মানুষ মানুষের প্রতি কী পরিমাণ নৃশংস হতে পারে, এতে আছে তার বিবরণ। অবিশ্বাস্য বর্ণনা!’

গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের বিষয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, ‘সরকারের (আওয়ামী লীগ সরকার) আক্রোশের শিকার হয়ে ঘটনাচক্রে যাঁরা এখনো বেঁচে আছেন, তাঁরা আজ পর্যন্ত মুখ খুলতে সাহস করছেন না। তাঁদের ভয় কিছুতেই কাটছে না। তাঁদের ভয়, হঠাৎ যদি ওই জালেমরা আবার ক্ষমতায় আসে, তাহলে তাঁদের প্রতি এরা নৃশংসতম হবে। গত সরকারের ঘৃণ্যতম অধ্যায়ের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে এই প্রতিবেদন অমর হয়ে থাকবে।’

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনাগুলো তদন্ত করতে অন্তর্বর্তী সরকার গত ২৭ আগস্ট গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠন করে। কমিশনের প্রধান করা হয় বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে। এই কমিশন ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ (সত্য উন্মোচন) শীর্ষক অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে।

এই কমিশন ১ হাজার ৬৭৬টি গুমের অভিযোগ পেয়েছে। এর মধ্যে ৭৫৮টি অভিযোগ পর্যালোচনা করেছে তারা। কমিশন এখন পর্যন্ত যে ৭৫৮ জনের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করেছে, তার মধ্যে ৭৩ শতাংশ ভুক্তভোগী ফিরে এসেছেন। বাকি ২৭ শতাংশ (অন্তত ২০৪ জন) এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।

শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন পড়ে মানুষ হতভম্ব

গণ–অভ্যুত্থানের পর অর্থনীতি কোন পরিস্থিতিতে যাত্রা শুরু করল, তার একটি দলিল রচনা করতে অন্তর্বর্তী সরকার শ্বেতপত্র কমিটি করেছিল। অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের ৪০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন ১ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়।

অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন পড়ে দেশের মানুষ হতভম্ব হয়ে গেছে বলে ভাষণে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, দেশে-বিদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি গভীর আগ্রহ নিয়ে এই প্রতিবেদন সংগ্রহ করছেন। দেশের মধ্যে পত্রপত্রিকা, সেমিনার, আলোচনা সভা ও টেলিভিশনে এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী সরকার দেশের অর্থনীতিকে ভেঙে দিয়ে গেছে—এটা সবাই বুঝতে পারছিল। কিন্তু অর্থনীতিকে কী পরিমাণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিয়ে গেছে, তার পরিমাপ সম্বন্ধে কোনো ধারণা করতে পারছিল না। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি হিসাব-নিকাশ করে এর পরিমাণ বের করে দিয়েছে।’

শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন পড়ে সবাই অবিশ্বাস্য চোখে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘কারও মুখে কথা বের হচ্ছে না। দিনদুপুরে সকলের সামনে থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে পাচার করে নিয়ে গেছে। কেউ বলার ছিল না। কেউ দেখার ছিল না। যারা নিয়ে গেছে, তাদের কেউ বাধা দেয়নি। বরং সর্বস্তরে সবাই আগ্রহসহকারে তাদের সহযোগিতা করেছে। কারণ, তারা সব আপন লোক।’

ঋণের টাকায় বিশাল বিশাল প্রকল্প নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, এসব প্রকল্পের মোড়কে বিশাল পরিমাণ অর্থ লুটপাট করেছে। প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে কত বেশি ব্যয় ধরে কাদের হাতে টাকাটা পাচার করে দেওয়া হয়েছে, তা-ও শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

ড. ইউনূস বলেন, শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে যে বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক টাকাই লুটপাট হয়েছে। দেশে এমন ধরনের পোষ্যতোষী পুঁজিবাদ তৈরি করা হয়েছিল, যার সুবিধাভোগী ছিল স্বৈরাচার ও তার সহযোগীরা। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে যে পরিমাণ করছাড় দেওয়া হয়েছে, সেটা অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে দেশের শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ ও স্বাস্থ্য বাজেট তিন গুণ করা সম্ভব ছিল।

জনগণের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘পাচার করা এই টাকা আপনাদেরই। তারা প্রকাশ্যে আপনাদের কষ্টার্জিত অর্থ লুট করে বিদেশে ভোগবিলাসে ব্যয় করেছে।’ এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘পাচার করা এই সীমাহীন অর্থ এখন আবার দেশে গোলযোগ সৃষ্টি করে তারা এ দেশে ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টির কাজে ব্যয় করছে।’

ড. ইউনূস বলেন, এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় কাজ হলো পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা। তারা তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে সেটা চেষ্টা করছে। কাজটা কঠিন; কারণ, এ-বিষয়ক আইন কঠিন। অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে সাহস ও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এই সরকারের আমলে আংশিক হলেও যেন টাকা ফেরত আনা যায়।

প্রতিবছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে হার দেখানো হয়েছে, সেটাও মনগড়া বলে ভাষণে উল্লেখ করা হয়।

অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও জীবনমান উন্নয়ন

জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, ‘নির্বাচন আয়োজন ও সংস্কার ছাড়াও আপনারা আমাদের ওপর অনেকগুলো দায়িত্ব দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও মানুষের জীবনমান উন্নয়ন। ফ্যাসিবাদী সরকারের কাছ থেকে আমরা বিপর্যস্ত এক অর্থনীতি পেয়েছি। আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।’

গত নভেম্বর মাসের রপ্তানি আয়ের চিত্র তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।

পোশাকশ্রমিকদের বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তাঁদের বার্ষিক মজুরি ৯ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। মূল্যস্ফীতির বিষয়টি বিবেচনা করে শ্রমিক ইউনিয়ন ও মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এটি নির্ধারণ করা হয়েছে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এ ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আমরা এখনো পাইনি। তবে আমার বিশ্বাস, মূল্যস্ফীতি শিগগিরই কমে আসবে। গত কয়েক মাসে বাজারে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। আমরা সরবরাহ বাড়িয়ে, আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়ে, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে ও বাজার তদারকির মধ্য দিয়ে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি এখনো পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। এটা সম্ভব হলে আমরা আশা করি জিনিসপত্রের দাম আরও কমে আসবে।’

আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, অতিরিক্ত মুনাফার লোভে যদি কেউ কৃত্রিম কোনো সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করে, তাকে কঠোর হাতে দমন করা হবে। এ ছাড়া বাজার সিন্ডিকেটের (অসাধু জোট) দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে বিকল্প কৃষিবাজার চালু করার লক্ষ্যে সরকারের কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।

ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান

ড. ইউনূস বলেন, জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশের ছাত্র-শ্রমিক-জনতা মিলে যে অসাধ্যসাধন করেছে, তার অন্যতম শক্তিশালী ভূমিকায় ছিল এ দেশের নারীরা। ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রাণঘাতী অস্ত্রের সামনে হিমালয়ের মতো দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবক, চাকরিজীবী, শ্রমজীবী—সব পেশার, সব বয়সের নারীরা এই আন্দোলনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।

ড. ইউনূস বলেন, যে তরুণীরা জুলাই আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকল, তারা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় থেকে আর কোনো দিন সরে যাবে না। তারা শুধু নতুন বাংলাদেশ নয়; নতুন এক পৃথিবী গড়ে তোলার মহাকর্মযজ্ঞে বাংলাদেশের সব বয়সের নারীদের সঙ্গে নিয়ে নেতৃত্ব দেবে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, এ বছর বেগম রোকেয়া দিবসে দেশজুড়ে আন্দোলনে নারীদের আত্মত্যাগ ও ভূমিকার বিষয়ে বড় আকারে আলোচনা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নারী অধিকার রক্ষায় নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন করেছে। শিগগিরই তারা তাদের রিপোর্ট দেবে। জুলাই কন্যারা ঘোষণা দিয়েছে, প্রতিবছরের ডিসেম্বরে নির্ধারিত সময়ে সারা দেশে সব পরিবারের নারী, শিশু–কিশোরী তরুণী–বৃদ্ধা, একসঙ্গে নিজ নিজ নির্ধারিত স্থানে সেটা উঠান হোক, বাড়ির সামনে রাস্তায় হোক, সমাবেশ করে দেশের অর্ধেকাংশ মানুষের অস্তিত্বের কথা সারা জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেবে। তাদের আশা–আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়ে দেবে।

বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অনেক অস্ত্রকে অগ্রাহ্য করে খালি হাতে রুখে দাঁড়িয়ে সম্মুখসমরে লড়াই করে নিজেদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উৎসবের দিন (১৬ ডিসেম্বর)। এই দিনে স্মরণ করি লক্ষ লক্ষ শহীদকে, অগণিত শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ জনতার আত্মত্যাগকে; যার ফলে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল।’

ড. ইউনূস বলেন, ‘বিজয়ের মাস হোক নারী, পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ রাজনৈতিক পরিচয়নির্বিশেষে জাতির মহা ঐক্যের মাস।’

বিজয়ের মাসে দল, মত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘শক্তিশালী স্বৈরাচারী সরকারকে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমেই আমরা হটাতে পেরেছি। তারা এখনো সর্বশক্তি দিয়ে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যকে নস্যাৎ করতে চাচ্ছে, একের প্রতি অন্যের বিষ উগরে দিতে চাচ্ছে। তাদের এই হীন প্রচেষ্টাকে কোনোভাবেই সফল হতে দেবেন না।’