সংসদে বিরোধী দল
সংকটের মূলে সরকারের ভুল নীতি, অব্যবস্থাপনা
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা বলেছেন, এখনো বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ বেশ শক্ত অবস্থানে আছে।
নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি এবং দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য জাতীয় সংসদে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য সরকারের অব্যবস্থাপনা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেওয়া ভুল নীতিকেও তাঁরা দায়ী করেন। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন নীতির সমালোচনা করেন তাঁরা।
বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের জবাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা বর্তমান পরিস্থিতির জন্য রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করেন। তাঁরা দাবি করেন, এখনো বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ বেশ শক্ত অবস্থানে আছে।
কোভিড-১৯, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, জ্বালানি–সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ সাম্প্রতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ জাতিকে জানাতে সংসদে সাধারণ প্রস্তাব আনেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মুজিবুল হক।
সাধারণ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা ও জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, পরিস্থিতি মূল্যায়নে সরকারের ব্যর্থতা ছিল। অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজির কথা বলছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। কিন্তু সরকারের সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকলে এটি হতো না। তিনি প্রশ্ন রাখেন, দেশে রিজার্ভ যথেষ্ট থাকলে ডলারে অস্থিরতা কেন?
আলোচনায় অংশ নিয়ে জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক বলেন, ‘সরকারের লোকেরা প্রত্যক্ষ করেন কি না জানি না। কিন্তু আমরা দেখি, মানুষ আসলেই খুব খারাপ অবস্থায় আছে। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং গরিব মানুষ বাজারে গেলে তাদের গায়ে আগুন লেগে যায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে।’
মানুষ আসলেই খুব খারাপ অবস্থায় আছে।
সরকার জ্বালানি কূটনীতিতে মনোযোগী নয় উল্লেখ করে মুজিবুল হক বলেন, ওপেকভুক্ত (জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন) তেল উৎপাদনকারী কোম্পানি এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে জ্বালানি সরবরাহের স্থায়ী কোনো চুক্তি করার উদ্যোগ নেই। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেয়ে স্পট মার্কেট (আন্তর্জাতিক খোলা বাজার) থেকে তেল আমদানি করার আগ্রহের পেছনে অন্তর্নিহিত কোনো স্বার্থ আছে। প্রাথমিক জ্বালানির উৎস এবং সরবরাহ নিশ্চিত না করেই সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্র করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
দেশে প্রতিবছর বেসরকারি বিদ্যুতকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়লেও বড় অংশ অলস পড়ে আছে জানিয়ে মুজিবুল হক বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে ক্যাপাসিটি চার্জের (বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া) নামে প্রচুর আয় করেছে বিনিয়োগকারীরা। ১২ বছরে এখানে খরচ হয়েছে ৮৬ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। এমনকি ভারতে থেকে গত ৯ বছরে বিদ্যুৎ আমদানিতে ক্যাপাসিটি চার্জ গেছে ১১ হাজার ১৫ কোটি টাকা। ভর্তুকির পুরোটাই অপ্রয়োজনীয়, অলস, রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি এবং ওভারহেডিং চার্জে গেছে। গত এক যুগে দেশে বিদ্যুৎ খাতের শীর্ষ ১০টি কোম্পানির ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ৪৪ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। এ আনুকূল্যের পেছনের সরকারের স্বার্থ কী, তা তিনি জানতে চান।
বিভিন্ন ব্যাংকে বিপিসির (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) ২৫ হাজার ২৬৪ কোটি জমা আছে জানিয়ে জাপার এই সংসদ সদস্য বলেন, ওই ব্যাংকগুলোর অবস্থা কাহিল। মানুষকে ঋণ দিয়ে তাদের এখন মূলধন নেই। বিপিসি চাইলেও টাকা তুলতে পারবে না। বিপিসি কার স্বার্থে এই টাকা ওই সব ব্যাংকে রেখেছে, সেটিও জানতে চান তিনি।
সরকারের জ্বালানি নীতির সমালোচনা করে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, শাসনক্ষমতার কেন্দ্রে আছে কিছু ক্ষুদ্র ধনিক ও আমলা গোষ্ঠী। তাদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে বৈশ্বিক কারণ আছে, এটা ঠিক। কিন্তু নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখা দরকার, নীতি সঠিক কি না। জ্বালানি নীতি মূলত আমদানিনির্ভর। এ কারণে জ্বালানি–সংকটের সময় এ খাত মুখ থুবড়ে পড়েছে। জ্বালানি তেলের যে দাম কমানো হয়েছে, তা হলো ‘গরু মেরে জুতা দান’।
‘অবস্থা অনেক মজবুত’
আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, ইউরোপে এখন ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। জার্মানির মতো দেশে হাহাকার চলছে। কোনো কোনো দেশে মূল্যস্ফীতি ২৩ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা অনেক মজবুত।
বিরোধী দলের সমালোচনার জবাবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এরশাদ সরকার ও বিএনপি জোট সরকারের আমলের পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিরোধী দল প্রথম আলোর প্রতিবেদন দেখিয়েছে। তিনিও প্রথম আলোর কিছু খবর তুলে ধরতে চান। এ সময় তিনি ২০০১-২০০৭ সালের বিদ্যুৎ ও পানি পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলো পত্রিকার বেশ কিছু প্রতিবেদনের কাটিং তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিরোধী দলের সদস্যদের ‘গোল্ডফিশ মেমোরি’। তাঁরা সব ভুলে গেছেন। এখন ভূতের মুখে রাম নাম। তাঁরা একই ভাঙা রেকর্ড বাজাচ্ছেন। ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া ছাড়া বিশ্বের কোথাও বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যায় না।
সত্য স্বীকারে আওয়ামী লীগের ব্যাপক ব্যর্থতা আছে।
নসরুল হামিদ বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরপর যখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে যায়, তখন দেশে দাম বাড়ালে ৬০ টাকা বাড়াতে হতো। এ কারণে সরকার অপেক্ষা করেছে তেলের দাম কমার জন্য। বৈশ্বিক অবস্থা, তেলের ঘাটতি ও প্রতিবেশী দেশে পাচারের আশঙ্কা বিবেচনায় পরবর্তী সময়ে তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে।
সত্য স্বীকারে ব্যর্থতা
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, সত্য স্বীকারে আওয়ামী লীগের ব্যাপক ব্যর্থতা আছে। তাদের উচিত সত্য স্বীকার করে নেওয়া এবং সমাধান বের করা। সংকট মোকাবিলায় সরকারের পরিকল্পনা কী, তা তুলে ধরা। তিনি প্রশ্ন রাখেন, বিপিসির টাকা কোথায় গেল। ১০টি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার পথে। সেসব ব্যাংকে কেন বিপিসির টাকা রাখা হলো। তিনি বলেন, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের সংকট—এগুলো নিয়ে আলোচনা দরকার। ক্ষমতায় থাকার জন্য সরকার গুম, খুনসহ যেসব কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি দিচ্ছে, তা এক সময় বুমেরাং হবে।
বিএনপির এই সংসদ সদস্য বলেন, চলমান সংকট থেকে বের হতে হলে দুর্নীতি, অপচয় বন্ধ করতে হবে। সরকারকে জবাবদিহির মধ্যে আসতে হবে। কর্তৃত্ববাদী আচরণ পরিহার করতে হবে।
মন্ত্রীরা স্বীকার করেন না
সরকারের নিশ্চয় কিছু ভুল আছে বলে উল্লেখ করেন জাপার সংসদ সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি বলেন, আইএমএফের কাছে চার বিলিয়ন ডলার চাওয়া হচ্ছে। এর চেয়ে বেশি ডলার আনা যেত যদি ‘সিস্টেমেটিক্যালি’ (নিয়মমাফিক) টাকার অবমূল্যায়ন করা হতো বা প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা বাড়ানো হতো।
জাপার আরেক সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, মন্ত্রীরা ব্যর্থতা ঢাকতে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। দেশে অভাব নেই, এটা ঠিক নয়। কিন্তু মন্ত্রীরা এটা স্বীকারই করতে চান না। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছেন। এর সঙ্গে সরকারের অনেকে জড়িত। তিনি প্রশ্ন রাখেন, যেসব ব্যাংক ডলারের দাম বাড়িয়েছে, সেসব ব্যাংকের এমডিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন।
বিএনপির সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, এই সরকারের উন্নয়নের বয়ানের মধ্যে ছিল অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয় দেখানো। সরকারের আচরণ বলছে, দেশের অর্থনীতি গভীর সংকটে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কাছে ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ চাওয়া, বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা, নানাভাবে সরকারের ব্যয় সংকোচনের মতো পদক্ষেপ তীব্র সংকটকে নির্দেশ করে।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে রুমিন বলেন, দ্রব্যমূল্য বাড়লে সমস্যায় পড়ে মধ্যবিত্ত। না পারে চাইতে, না পারে সইতে।
রুমিন প্রশ্ন তোলেন, বর্তমান সংকট কি ভুল নীতির কারণে? নাকি ভয়ংকর লুটপাটের অনিবার্য পরিণতি।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের কষ্টের জন্য নিজের এবং সরকারের পক্ষ থেকে মাফ চান হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, মানুষ কষ্টে আছে। এটি হঠাৎ শুরু হয়েছে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। কিন্তু মানুষকে সমবেদনা জানানোর বদলে কিছু মন্ত্রী ঠাট্টা–মশকরা করছেন। এটা দুর্ভাগ্যজনক।
সরকার অনেক ভুল করেছে, এখন ভুল স্বীকার করার সময় জানিয়ে জাপার সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, ‘উন্নয়নের অহমিকা বিপজ্জনক।’