অন্তর্বর্তী সরকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের সুপারিশ তৈরির জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। গণতান্ত্রিক উত্তরণের যে উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে, সেই পথ কি সঠিক রয়েছে?
শাহদীন মালিক: এখন তো অন্তর্বর্তী সরকারের মাত্র এক মাস কয়েক দিন হলো। ফলে কোন পথে এগোচ্ছে—এটা এখন বলাটা অপরিপক্ব বিষয় হবে। তবে এটা খুব কঠিন কাজ হবে। আমরা যদি গণতন্ত্রের সবচেয়ে সীমিত অর্থে বলি যে একটি ভালো নির্বাচন করা দরকার। আমরা বাংলাদেশের এই ৫৩ বছরে তিন–চারটি ভালো নির্বাচন করতে পেরেছি। এ ছাড়া গণতন্ত্রের অন্য যে বিভিন্ন দিক আছে, আমরা এখনো ওই সব সম্পর্কে চিন্তাই করতে পারছি না। তো এখন এই নতুন সরকারের সর্বক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ণ করার যে বিষয় আসছে, সেখানে আমার মনে হয় না যে রাজনৈতিক জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার ছাড়া কারও পক্ষে তা করা সম্ভব। তবে এই সংস্কারের বা গণতন্ত্রায়ণের যাত্রা যদি অন্তর্বর্তী সরকার শুরু করে দিতে পারে, তাহলে সারা জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে বলে আমার মনে হয়।
নির্বাচনী ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে উত্তরণ বেশ কঠিন কাজ, যেটা আপনিও বলছেন। এর যাত্রা কীভাবে শুরু হতে পারে?
শাহদীন মালিক: আসলে যে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে বলা হচ্ছে, এগুলো হলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আগে রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত গত ৫৩ বছরে রাজনৈতিক দলগুলো সবচেয়ে বেশি অগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। কোনো রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন; এটা খুবই দুষ্কর। আমি মনে করি, সবচেয়ে অগণতন্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে গণতন্ত্র আশা করা বৃথা বলে আমার মনে হয়। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রায়ণ করা দরকার। এটিও এক দিনে হবে না। এখন এই যাত্রার প্রথম পদক্ষেপই তো আমরা নিইনি। এ ব্যাপারে বড় দলগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের অভাবের কথা আপনি বলছেন। একই সঙ্গে বলছেন, রাজনৈতিক জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার ছাড়া কারও পক্ষে গণতন্ত্রায়ণ করা সম্ভব নয়। সেখানে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের জন্য নির্বাচনের প্রশ্নে সরকারের দিক থেকে অস্পষ্টতা রয়েছে বলে বিএনপিসহ কোনো কোনো দল অভিযোগ তুলেছে। আপনি কী বলবেন?
শাহদীন মালিক: এটা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচন চাইবে। কারণ, নির্বাচন হলে তাদের তাড়াতাড়ি ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। এখানে আমার ভুলও হতে পারে; তবে আমার মনে হয়, তাড়াতাড়ি নির্বাচন করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর এই চাপের মুখে সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর গণতন্ত্রায়ণ কতটা করতে পারবে, এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। দলগুলো বলবে, গণতন্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার ছয় মাস বা এক বছরের মধ্যে করা সম্ভব নয় এবং কাজটা শুরু করে নির্বাচন দেন। ফলে ছয় মাস বা এক বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠাগুলোর সংস্কার করে নির্বাচন অনুষ্ঠান কীভাবে করবে, এর সমাধান এখনো দৃশ্যমান নয়। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
এখন সংবিধান সংস্কারের প্রশ্নে নানা আলোচনা চলছে। বর্তমান সংবিধানের আওতায় গত ১৫ বছরে স্বরতন্ত্র বা ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে অনেকে বলছেন। সংবিধানে কী ত্রুটি আছে; আর ত্রুটির কারণেই কি তা হয়েছে?
শাহদীন মালিক: আইনে সব সময় ভালো কথা লেখা থাকে। উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, চুরি করা অপরাধ এবং এতে শাস্তি সাত বছরের জেল; কিন্তু চুরি তো হচ্ছে। আমি মনে করি, এখানে আইনটির দোষ খুব কম। এখানে যারা চুরি করছে তাদের দোষ। মানে কোনো অপরাধ হলে আমরা আইনটির দোষ দিই এবং বলি যে আইনটি ঠিক নেই; এর সংস্কার করতে হবে, যুগোপযোগী করতে হবে ইত্যাদি। এই ধারণার সঙ্গে আমি একমত নই। আইন আপনি যত ভালোই লেখেন না কেন, আইন যাঁরা বাস্তবায়ন করবেন, তাঁদের মধ্যে গলদ থাকলে সমস্যা হবে। একই সঙ্গে এটিও বলি, সংবিধানে কিছু গলদ আছে। কী গলদ আছে, সেটি সবার সঙ্গে আলোচনা করে এটিকে নির্দিষ্ট করে সমাধান বের করতে হবে; কিন্তু মূলকথা হলো আমাদের যে আইনের শাসন হচ্ছে না, এটা আইনের অভাবে নয়।
কিন্তু এই সংবিধানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারে প্রধানমন্ত্রীর হাতে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এটি ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি করে বলে বলা হচ্ছে।
শাহদীন মালিক: হ্যাঁ, এখানে নিঃসন্দেহে একটি গলদ আছে। এ ছাড়া একই ব্যক্তি দলের, সংসদীয় দলের ও সরকারের প্রধান হচ্ছেন। এখানে ভারসাম্য আনতে হবে। মানে একই ব্যক্তির এই তিন পদে একসঙ্গে থাকা—এটি সঠিক নয়।
এখন বর্তমান সংবিধানই বাদ দিয়ে পুনর্লিখনের দাবিও করা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। আপনি কী মনে করেন?
শাহদীন মালিক: হ্যাঁ, সংবিধান সংশোধন, বাদ দেওয়া, পুনর্লিখন—বিভিন্নভাবে বলা হচ্ছে। আসলে কী করা হবে, এটি আমাদের আলাপ–আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্য।
শাহদীন মালিক: আপনাকেও ধন্যবাদ।