সর্বশেষ গত বুধবার অনুষ্ঠিত ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একতরফা নিয়ন্ত্রণ অনেক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ছিল। এরপরও ভোটাররা যেখানে যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন, সেই পরিস্থিতির বিবেচনায় তাঁরা প্রতিবাদ করেছেন বলা যায়। আলোচিত বগুড়া-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলম খুবই কম ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন আওয়ামী লীগের শরিক জাসদের প্রার্থীর কাছে।
কোনো দলের ঢাল না থাকলেও হিরো আলম যে জয়ের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন, সেটি ক্ষমতাসীনদের জন্য বিব্রতকর কি না—এমন আলোচনাও উঠেছে। তবে সার্বিকভাবে এই উপনির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ না থাকার বিষয়টি নির্বাচন নিয়ে মানুষের অনাস্থা বা একধরনের প্রতিবাদ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।
ভোটের দিনের পরিস্থিতি এবং ফলাফলের যে চিত্র পাওয়া গেছে, তাতে নির্বাচনের ব্যাপারে মানুষের আস্থা বাড়েনি, বরং কমেছে। বছরখানেক পর যে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে, সেই নির্বাচনও একইভাবে হবে কি না—মানুষের মধ্যে সেই সন্দেহ আরও বেড়েছে বলে মনে হয়।
বিরোধী বিএনপির নেতাদের অনেকে মনে করেন, এই উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলছুট প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে এবং কোনো কোনো আসনে শরিকদের ছাড় দিয়ে নতুন ‘মডেল’ আনছে। জাতীয় নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ তাদের এই কৌশল নিয়ে এগোনোর চেষ্টা করতে পারে। সে ব্যাপারে বিএনপি সতর্ক রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ নতুন কোনো মডেলের বিষয় মানতে রাজি নয়।
এই উপনির্বাচনে বিশেষভাবে আলোচনায় ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন। সেখানে বিএনপির দলছুট প্রার্থী উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে সমর্থন দিয়ে আওয়ামী লীগ কার্যত সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। ভোটের মাঠ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সরিয়ে দেওয়া এবং ভোটের দিনে ক্ষমতাসীনদের নানা রকম ব্যবস্থাপনা ছিল। শেষ পর্যন্ত দুর্বল প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উকিল সাত্তার জিতেছেন। কিন্তু এই আসনে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে বাকি পাঁচটি আসনের তুলনায়। অনেকটা ভোটারবিহীন নির্বাচন বলা যেতে পারে। আসনটিতে ভোট পড়েছে মাত্র ১৬ দশমিক ১০ শতাংশ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মানুষের মধ্যে ভোট নিয়ে যে অনাগ্রহ ছিল, সেটা নির্বাচন এবং ক্ষমতাসীনদের প্রতি অনাস্থার প্রকাশ হতে পারে। নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলেছেন, ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদপুষ্ট প্রার্থীকেই জেতানো হবে—এ ধারণা হয়েছিল ভোটারদের। এটিও ভোট দেওয়ার অনাগ্রহের একটি কারণ।
খুবই কম ভোটে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হওয়ায় ভিন্ন রকম আলোচনা চলছে বগুড়া-৪ আসন নিয়ে। কাহালু ও নন্দীগ্রাম—এ দুটি উপজেলা নিয়ে এ আসনে মাত্র ৮৩৪ ভোটে হেরেছেন হিরো আলম। আওয়ামী লীগের শরিক জাসদের এ কে এম রেজাউল করিম সেখানে জিতেছেন। হিরো আলম ভোট পেয়েছেন ১৯ হাজার ৫২৪ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও তিনি যে ভোট পেয়েছেন, তা এখন আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। যাঁরা ভোট দিয়েছেন বা ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁদের বড় অংশ ক্ষমতার ধারেকাছে নেই—এমন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমকে বিকল্প বেছে নিয়েছেন। এই ভোটাররা নির্বাচনী ব্যবস্থা ও ক্ষমতাসীনদের প্রতি একধরনের অনাস্থার প্রকাশ ঘটিয়েছেন বলা যায়।
তবে বগুড়া-৬, যেটি শহরের আসন, সেখানে আওয়ামী লীগ কোনো ঝুঁকি নেয়নি বলেই মনে হয়েছে। সেখানে দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীর অভিযোগ, ভোটের দিন দুপুরের মধ্যেই বেশির ভাগ কেন্দ্র দখল করে নেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী। আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেখানে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু ভোটকেন্দ্র দখলের সেই পুরোনো কায়দা ব্যবহৃত হয়েছে। এর পেছনে ক্ষমতাসীনদের নিজেদের প্রতি কোনো ধরনের আস্থার ঘাটতি ছিল কি না—সেই প্রশ্নও থেকে যায়।
আস্থার সংকট বাড়বে
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন, তারপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন ও অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের টানা প্রায় দেড় দশকের শাসনে বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠিত উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভোট দিতে না পেরে দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশে যে ক্ষোভ ও আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, তা এখন আলোচনার নতুন কোনো বিষয় নয়।
বছরখানেকের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। এরই মধ্যে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছে। এ রকম একটা সময় ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আচরণের দিকে সবার নজর ছিল। উপনির্বাচনের চিত্র দেখে মনে হয়েছে, ক্ষমতাসীনেরা কোনো কিছুই বিবেচনায় নেননি; বরং বিরোধী দল আগামী নির্বাচনে না এলে তাদের থেকে দলছুট কাউকে প্রার্থী করার কৌশল থাকবে, আওয়ামী লীগ এই নতুন বার্তা দিতে চেয়েছে বলে বিএনপির নেতাদেরই অনেকে মনে করছেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বর্তমান নির্বাচন কমিশন দিয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলে তাঁরা যে বক্তব্য দিয়ে আসছেন, সর্বশেষ উপনির্বাচনে সেটা আরেকবার প্রমাণ হয়েছে। তিনি মনে করেন, বিএনপি অংশ না নেওয়ার পরও ছয়টি আসনে যেভাবে উপনির্বাচন হলো, তাতে নির্বাচন নিয়ে মানুষের আস্থার সংকট আরও বাড়বে।
তবে এসব কোনো অভিযোগই আমলে নিতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, এই উপনির্বাচনের মাধ্যমে ভোটের প্রতি মানুষের আস্থা আরও বেড়েছে বলে তাঁরা মনে করেন। তিনি বলেন, একটি বড় দল অংশ না নেওয়ায় উপনির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। সে কারণেও ভোটারের আগ্রহ কম ছিল।
জাতীয় নির্বাচনের আগে ছয়টি আসনে এই উপনির্বাচনে সরকার ভোটের কোন ধরনের মডেল ব্যবহার করে, সে বিষয়ে অনেকের আগ্রহ ছিল। তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, আগামী নির্বাচনে এই মডেল ব্যবহার হবে কি না—সেই সন্দেহ রয়েছে।
নির্বাচনী পর্যবেক্ষক মুনিরা খান মনে করেন, কয়েকটি আসনে উপনির্বাচনে যদি মাস্তানি এবং অনিয়ম ঠেকানো না যায়, তাহলে সাধারণ নির্বাচনে কী হবে? সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের এসব প্রশ্ন বিবেচনায় নেওয়া উচিত।