নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার
ইসিকে দায়বদ্ধ করার কথা ভাবছে কমিশন
ব্যবস্থা নেওয়ার পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া এখনো ঠিক হয়নি।
তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন করে পার পেয়ে গেছে কমিশন।
সাংবিধানিকভাবে জাতীয় সংসদ ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। মূলত ইসির নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে মাঠে রিটার্নিং কর্মকর্তারা সংসদীয় আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাজটি করে থাকেন। রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত কর্মকর্তা এবং প্রার্থী বা তাঁদের সমর্থকেরা কোনো ধরনের অপরাধে জড়ালে জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) এবং
নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন ও সংশ্লিষ্ট বিধিতে নানা ধরনের শাস্তির বিধান আছে। ইসির কাছে তাঁরা দায়বদ্ধ। তবে ইসি নিজেই যদি কোনো অপরাধে সম্পৃক্ত হয়, তাহলে কী হবে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু নেই।
বিদ্যমান সংবিধানে নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণ করার বিধান আছে। সংবিধানে বলা আছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক যে পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হতে পারেন, একই পদ্ধতি ও কারণ ছাড়া কোনো নির্বাচন কমিশনার অপসারিত হবেন না। এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তাঁদের অপসারণ করার সুযোগ আছে। একসময় এই ক্ষমতা ছিল সংসদের হাতে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, অতীতের সর্বশেষ তিনটি জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা মনে করছে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলেও ইসিকে দায়বদ্ধ করার সুস্পষ্ট জায়গা থাকা উচিত। ২০১৪ সালের একতরফা একাদশ সংসদ নির্বাচন, ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোট’ এবং সর্বশেষ চলতি বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত পাতানো নির্বাচন অনুষ্ঠানে ওই সময়ের তিনটি নির্বাচন কমিশনের দায় ছিল। তাঁরা মূলত সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করার শপথ নিয়েছিলেন। কিন্তু বিতর্কিত নির্বাচন করে তাঁরা সে শপথ ভঙ্গ করেছেন। এর মধ্যে কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের বিরুদ্ধে জাতীয় নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ এবং আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ এনে তা তদন্তে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবিতে রাষ্ট্রপতিকে দুই দফা চিঠি দিয়েছিলেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। কিন্তু বিতর্কিত তিনটি নির্বাচন পরিচালনাকারী কোনো কমিশনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
গত ৩ অক্টোবর নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের জন্য সুপারিশ দিতে বদিউল আলমের নেতৃত্বে সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সুপারিশ তৈরির জন্য অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময়, ডিজিটাল মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়া এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে লিখিত প্রস্তাব নিয়েছে কমিশন।
‘কেউ দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে নন’
সংস্কার কমিশন মনে করছে, নির্বাচনী অপরাধের জন্য নির্বাচন কমিশনারদের দায়বদ্ধ করার জন্য আরপিওতে এ–সংক্রান্ত বিধান যুক্ত করা হতে পারে; যাতে নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠলে তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এর পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া কী হতে পারে, তা নিয়ে সংস্কার কমিশন চিন্তাভাবনা করছে। এখনো সেটি চূড়ান্ত হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে কেউ দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে নন। সাংবিধানিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সংবিধান সমুন্নত রাখবেন। তাঁরা যদি শপথ ভঙ্গ করেন, তাহলে তাঁদেরও দায়বদ্ধ করা উচিত।
গত ৩ অক্টোবর নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের জন্য সুপারিশ দিতে বদিউল আলমের নেতৃত্বে সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সুপারিশ তৈরির জন্য অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময়, ডিজিটাল মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়া এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে লিখিত প্রস্তাব নিয়েছে কমিশন। পাশাপাশি নিজেরা নির্বাচনসংক্রান্ত সব আইন-বিধি পর্যালোচনা করেছে। এখন প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছে এই কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার কথা আছে। তবে এখন পর্যন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয়নি।
প্রস্তাব দেখে প্রতিক্রিয়া
ইসিকে দায়বদ্ধ করা নিয়ে সংস্কার কমিশনের চিন্তার বিষয়ে এখনই কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে চায় না বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাব দেওয়ার পর সেটি দেখে মন্তব্য করা সমীচীন হবে।
তবে নির্বাচন কমিশনকে জবাবদিহি ও দায়বদ্ধ করার একটি ব্যবস্থা থাকা দরকার বলে মনে করেন গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভুয়া, প্রতারণামূলক, ভোটাধিকার হরণের নির্বাচন করে নির্বাচন কমিশনগুলো পার পেয়ে গেছে। ভবিষ্যতে যাতে ভুয়া নির্বাচন করে পার পেতে না পারে, সে জন্য ইসির দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির ব্যবস্থা রাখা উচিত। তাঁরা এ ধরনের ব্যবস্থাকে সমর্থন করবেন।
ক্ষমতা বাড়ানোর চিন্তাও আছে
ইসিকে দায়বদ্ধ করার পাশাপাশি সাংবিধানিক এই সংস্থার ক্ষমতা বাড়ানোরও প্রস্তাব করার কথা ভাবা হচ্ছে। সংস্কার কমিশন মনে করছে, বর্তমানে ইসির যে ক্ষমতা দেওয়া আছে, তার যথাযথ প্রয়োগ করতে পারলে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সেটা যথেষ্ট। তবে আরপিওতে কিছু বিষয় আরও স্পষ্ট করা হবে। আরপিওতে যেসব ক্ষমতার কথা বলা আছে, তার বাইরে ইসির ‘অন্তর্নিহিত ক্ষমতা’ আছে বলে উচ্চ আদালতের দুটি রায়ে বলা আছে। এই অন্তর্নিহিত ক্ষমতার বিষয়টি আইনে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হতে পারে। কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনের আমলে আরপিওতে সংশোধনী এনে ভোট বন্ধে ইসির ক্ষমতা খর্ব করা হয়। যেভাবে সংশোধনী আনা হয়, তাতে ইসি শুধু ভোটের দিন নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করতে পারবে। আগে যেভাবে ছিল তাতে তফসিল ঘোষণার পর থেকে যেকোনো সময় পরিবেশ অনুকূল মনে না করলে ভোট বন্ধ ঘোষণার এখতিয়ার ইসির ছিল। এখন আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব করার কথা ভাবা হচ্ছে।
এ ছাড়া নির্বাচনী কিছু অপরাধের অভিযোগে এখন নির্বাচনের ছয় মাসের মধ্যে মামলা করার কথা আইনে বলা আছে। এখানে সংশোধনী প্রস্তাব করা হচ্ছে। এই ছয় মাসের সময়সীমাটা আরও বাড়ানো বা তুলে দেওয়া হতে পারে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও অন্তর্বর্তী সরকারের নৌপরিবহন এবং শ্রম কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ইসিকে দায়বদ্ধ করার জায়গা যে একেবারে নেই, তা নয়। ইসি সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন। সংবিধানের অভিভাবক হচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট। কয়েকটি বিষয় ছাড়া ইসির সব সিদ্ধান্ত নিয়ে যে কেউ উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন কী চিন্তা করছে, তারা সরাসরি কোনো বিধানের কথা ভাবছে কি না, তা তিনি জানেন না। তবে কোনো ধরনের কমিটি করে দায়বদ্ধতার জায়গা তৈরি করতে গেলে ইসি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে কি না, সেটাও দেখতে হবে।