ফিরে দেখা
ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হয় যেভাবে
৩৬ বছর আগে বাংলাদেশের সংবিধানে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সাবেক সামরিক শাসক লে. জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনের শেষ দিকে ১৯৮৮ সালের ৭ জুন জাতীয় সংসদে পাস করা হয় সংবিধানের এই অষ্টম সংশোধনী। সে সময় এর প্রতিবাদ হলেও পরে কোনো সরকারই তা বাদ দেয়নি। কোন প্রেক্ষাপটে, কীভাবে সংসদে পাস হয়েছিল এই সংশোধনী?
সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পুরোপুরি পাল্টে দেওয়া হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছিল ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। আর জেনারেল এরশাদের শাসনামলে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয় সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে।
দেশের চতুর্থ জাতীয় সংসদে এই সংশোধনী পাস করা হয়। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত এই সংসদের নির্বাচন বর্জন করেছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে সে সময় জোরদার হয়েছিল রাজপথের আন্দোলন। সেই আন্দোলনের মুখে জেনারেল এরশাদ তাঁর দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে ছোট ছোট ছয়টি দলকে নিয়ে ওই নির্বাচন করেছিলেন।
চতুর্থ জাতীয় সংসদে জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন মওদুদ আহমদ। তিনিই সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী সংসদে তুলেছিলেন। প্রয়াত মওদুদ আহমদ এরশাদ সরকারের পতনের পর বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন।
জেনারেল এরশাদ মৃত্যুর তিন বছর আগে ‘আমার কর্ম আমার জীবন’ শিরোনামে তাঁর জীবনীগন্থ প্রকাশ করেন ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। সেই বইয়ে তিনি লিখেছেন, দীর্ঘদিন ধরে আলাপ–আলোচনার পর জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের বৈঠকে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার অষ্টম সংশোধনী বিল অনুমোদন করা হয়। এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৮ সালের ১১ মে সংসদ ভবনের কমিটি কক্ষে। সেদিনই বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন তৎকালীন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী মওদুদ আহমদ।
বিলটির উত্থাপনের ২৭ দিন পর ১৯৮৮ সালের ৭ জুন রাত ৮টা ১০ মিনিটে স্পিকার শামসুল হুদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশনে অষ্টম সংশোধনী বিল পাস হয়। বিলটি পাস হয়েছিল ২৫৪–০ ভোটে।
সংসদে বিল পাসের সময় এর পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে মওদুদ আহমদ বলেন, ‘এ দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের ইসলামি মূল্যবোধ, আচার–ব্যবহারের প্রতিফলন সংবিধানে না থাকলে কিসের প্রতিফলন থাকবে?’ এ বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে এরশাদের বইয়ে।
জেনারেল এরশাদ লিখেছেন, ‘অষ্টম সংশোধনী বিলের মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করার ফলে জনগণের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় এবং আমরা একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার সুযোগ লাভ করি।’
অষ্টম সংশোধনীতে যা ছিল
এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের পাঁচটি ধারায় সংশোধনী আনা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়ই ছিল রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের স্বীকৃতি।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশে যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা ছিল, কিন্তু অষ্টম সংশোধনীতে তার জায়গায় রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম এসেছিল।
এই সংশোধনীতে আরেকটি বড় বিষয় আনা হয়েছিল। সেটি হচ্ছে, ঢাকার বাইরে হাইকোর্টের ছয়টি স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা।
তবে সে সময়ই আইনজীবীরা এর প্রতিবাদ করেন এবং সর্বোচ্চ আদালত ঢাকার বাইরে হাইকোর্টের বেঞ্চ গঠনের বিষয়টি বাতিল করে দেন।
প্রতিবাদ করেছিল বেশির ভাগ দল
সংসদে অষ্টম সংশোধনী বিল পাসের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ব্যাপক। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮–দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বে ৭–দলীয় জোট, বামপন্থী দলগুলোসহ অধিকাংশ দল ১৯৮৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে এরশাদ সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করেছিল। সেই নির্বাচনে গঠিত সংসদে যখন অষ্টম সংশোধনী বিল পাস করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তখন আন্দোলনে থাকা সব দলই এর প্রতিবাদ জানায়। তাদের প্রতিবাদে রাজনীতির অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল।
আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ আন্দোলনকারী দলগুলো ওই সংশোধনীর বিরুদ্ধে ১৯৮৮ সালের ১২ জুন সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত সারা দেশে হরতাল পালন করে।
সে সময় পত্রপত্রিকায় নেতাদের যেসব বক্তব্য প্রকাশিত হয়, তাতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্যান্য দলের শীর্ষ নেতারা বলেছিলেন যে অষ্টম সংশোধনী দেশের মানুষ মেনে নেবে না। এর মাধ্যমে জাতিকে বিভক্ত করা হবে বলে তাঁরা অভিযোগ তুলেছিলেন।
দুটি বড় দলের নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলনের মুখে জেনারেল এরশাদ তাঁর শাসনের শেষ সময় টিকে থাকার জন্য ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন সংবিধান সংশোধন করে। এটি তখনকার প্রেক্ষাপটে এরশাদের রাজনৈতিক কৌশল ছিল। তখন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নেতাদের বক্তব্যে এ ধরনের অভিযোগ উঠেছিল।
যদিও রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের পাশাপাশি ১৯৮৮ সালের ৮ জুন থেকে পরবর্তী কয়েক দিনের দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় জেনারেল এরশাদের যেসব বক্তব্য প্রকাশিত হয়, তাতে তাঁর মূল বক্তব্য ছিল, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হলেও অন্যান্য ধর্ম পালনের অধিকারও অষ্টম সংশোধনীতে নিশ্চিত করা হয়েছে। তাঁর এ বক্তব্য তখন আন্দোলনকারী দলগুলো প্রত্যাখান করেছিল। পরে এরশাদ তাঁর বইয়েও লিখেছেন, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাবে’।
জাতীয় পার্টির নেতা কাজী ফিরোজ রশিদ ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকারের টেলিযোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতার শেষ সময় এরশাদ টিকে থাকতে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করেছেন, এ অভিযোগ মানতে রাজি নন তাঁরা।
তবে যে সংসদে অষ্টম সংশোধনী বিল পাস হয়েছিল, সেই সংসদ টিকে ছিল ২ বছর ৭ মাস। গণ–আন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর।
পরিবর্তন আনেনি কোনো সরকার
এরশাদ সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, কোনো দলের সরকারই রাষ্ট্রধর্মের বিষয়ে পরিবর্তন আনেনি।
২০০৯ সাল থেকে টানা ৪ দফায় সরকারে রয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটির সরকার ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনেছে।
সেই সংশোধনীর মাধ্যমে ’৭২–এর সংবিধানের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বহাল রাখা হয়। এ নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। তবে এর পক্ষেই সরকার থেকে যুক্তি দেওয়া হয়।
এ ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের পাশাপাশি অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ বিবেচনায় সর্বোচ্চ দণ্ডের বিধান আনা হয়েছে।