সরকার পদত্যাগের ‘এক দফা’ দাবিতে পদযাত্রার কর্মসূচিকে ‘বিজয়ের লক্ষ্যে যাত্রা’ বলে অভিহিত করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, শুধু বিএনপি নয়, ৩৬টি রাজনৈতিক দল একযোগে ঘোষণা দিয়েছে, এ সরকারকে এখনই পদত্যাগ করতে হবে। এ লক্ষ্যে আজ (গতকাল) সারা দেশে এই পদযাত্রার কর্মসূচি।
রাজধানীর গাবতলীতে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বিএনপির পদযাত্রাপূর্ব এক সমাবেশে মির্জা ফখরুল ইসলাম এ কথা বলেন।
গতকাল সারা দেশসহ ঢাকায় দুই দিনের এই পদযাত্রা কর্মসূচির উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, এটা শুধু পদযাত্রা নয়, এটা জয়যাত্রা। এটা হচ্ছে মানুষের অধিকার আদায়ে বিজয়ের লক্ষ্যে যাত্রা।
সরকার পদত্যাগের দাবিসংবলিত বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে এই পদযাত্রায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার নেতা-কর্মী অংশ নেয়। অনেকের হাতে ছিল দলীয় ও জাতীয় পতাকা।
বেলা সাড়ে ১১টায় গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে পদযাত্রা শুরু হয়। প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ ঘুরে পদযাত্রাটি যখন বাহাদুর শাহ পার্কে গিয়ে শেষ, তখন সন্ধ্যা পৌনে সাতটা বেজে যায়। সাড়ে ১১টায় পদযাত্রা শুরু হলেও সকাল ১০টার আগে থেকে বিএনপির কর্মী-সমর্থকেরা গাবতলীতে জড়ো হতে থাকেন। ফলে এই পদযাত্রায় প্রায় ১০ ঘণ্টা রাস্তায় কাটাল বিএনপি। আজ বুধবার উত্তরার আবদুল্লাহপুর থেকে আরেকটি পদযাত্রা হবে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা পর্যন্ত। এই পদযাত্রার পথ প্রায় ৩২ কিলোমিটার।
বিএনপির এই পথযাত্রা ঘিরে গাবতলী থেকে যাত্রাপথের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থানে থাকতে দেখা গেছে। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা মিরপুরের বাঙলা কলেজ এলাকায় পদযাত্রায় হামলা করেন। এতে বেশ কিছু কর্মী-সমর্থক আহত হন। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
১২ জুলাই ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ থেকে এই পদযাত্রার কর্মসূচি ঘোষণা হয়।
‘এক দফা, এক দাবির’ উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল সরকারের উদ্দেশে বলেন, অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। সংসদ বিলুপ্ত করে একটা নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা দিতে হবে। নইলে ফয়সালা হবে রাজপথে।
আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘তারাও এক দফা ঘোষণা করেছে—শেখ হাসিনার অধীনই নির্বাচন হবে। আমরাও খুব পরিষ্কার করে বলেছি, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়।
উপনির্বাচনের তামাশা ও হিরো আলম
সমাবেশে মির্জা ফখরুল বলেন, গতকাল (সোমবার) ঢাকায় নির্বাচন কমিশন একটা উপনির্বাচনের তামাশা করেছে। সেই উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিল অত্যন্ত হেভিওয়েট প্রার্থী। সে আবার আওয়ামী লীগের থিঙ্কট্যাংকের প্রধান, দেশের সব মানুষ তাঁকে চেনে প্রফেসর ডক্টর আরাফাত। কিন্তু তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কে? হিরো আলম।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘ওই নির্বাচনেও ভোটারদের নিতে পারেনি, ভোটকেন্দ্র খালি। পঙ্গু নির্বাচন কমিশনের হিসাবমতে ১১ শতাংশ ভোট পড়েছে। আমরা টেলিভিশনে দেখলাম, কোথাও ভোটার নেই। পাঁচ ঘণ্টা পর একটা ভোটার এসেছে, ওকে নিয়ে লাফালাফি কাড়াকাড়ি। ওই ভোটের রেজাল্টের পরে আরাফাত সাহেব আঙুল দেখায়, ভিক্টরি। লজ্জা লজ্জা, লজ্জা।’
নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমকে মারধরের সমালোচনা করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘হিরো আলম এ দেশে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন। তাঁর সঙ্গে নির্বাচন করতে গিয়ে তাঁকে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে সাপ যেভাবে মারে, সেভাবে তাঁকে মারা হয়েছে গতকাল।’
পুলিশের ভূমিকার সমালোচনা করে ফখরুল বলেন, ‘আবার পুলিশ বলে কি, আমরা তো আমাদের কাজ করেছি। ঠিকই করেছেন, একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বীকে যখন মারছে, তখন আপনারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন। আর নির্বাচন কমিশন বলছে, এটা নাকি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। এসব তামাশা করে, জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে কোনো লাভ নেই।’
অসৎ ব্যবসায়ীদের সরকার
মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেন, ২০১৪ সালে ১৫৪ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করে ক্ষমতায় এসেছে সরকার। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগের রাতে ভোট করে আবার ক্ষমতায় এসেছে। আর এই ১০-১৫ বছরে বাংলাদেশের মানুষের পকেট খালি করে দিয়েছে সরকার।
এই সরকার অসৎ ব্যবসায়ীদের সরকার বলে মন্তব্য করেন ফখরুল। তিনি বলেন, জনগণের টাকা লুট করে নিচ্ছে, যারা এলএনজির দাম বাড়ায়, বিদ্যুতের দাম বাড়ায়, লুটপাট করে টাকা বিদেশে নিয়ে যায়, সিঙ্গাপুর, কানাডায় বাড়ি বানায়…তাদের জন্য এই সরকার।
৯৯ শতাংশ ব্যবসায়ী সরকারের বিদায় চান
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গত শনিবার অনুষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সম্মেলনের প্রসঙ্গ তোলেন। সেখানে বেশ কিছু ব্যবসায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় দেখার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। আমীর খসরু দাবি করেন, তাঁকে বর্তমান একজন ব্যবসায়ী নেতা বলেছেন, তাঁদের ওপর নাকি চাপ সৃষ্টি করে এই সম্মেলন করা হয়েছে।
আমীর খসরু বলেন, দেশের ৯৯ শতাংশ ব্যবসায়ী এই সরকারকে বিদায় করতে চান। তাঁরা আজকে এলসি খুলতে পারছেন না। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের উচ্চ বিল দিয়ে তাঁরা ব্যবসা করতে পারছেন না। ব্যাংকগুলো লুটপাটের কারণে সাধারণ ব্যবসায়ীরা আজকে ঋণ নিতে পারছেন না।
বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমানের সভাপতিত্বে ও সদস্যসচিব আমিনুল হকের সঞ্চালনায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুক, দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম।
সাড়ে চার ঘণ্টায় মগবাজার
বেলা সাড়ে ১১টায় পদযাত্রাটি গাবতলী থেকে শুরু হয়। সেটি মিরপুরের টেকনিক্যাল, মিরপুর ১ নম্বর, ১০ নম্বর, কাজীপাড়া-শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, ফার্মগেট, এফডিসি হয়ে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা পর মগবাজার মোড়ে গিয়ে পৌঁছায়। মাঝখানে কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়ায় নেতা-কর্মীরা একটু জিরিয়ে নেন। মগবাজার পর্যন্ত পদযাত্রা করে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি। এরপর মগবাজার থেকে মালিবাগ, শান্তিনগর, কাকরাইল, নয়াপল্টন, মতিঝিল, টিকাটুলী, দয়াগঞ্জ হয়ে বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত পদযাত্রা করে দক্ষিণ বিএনপি। এর আগে মগবাজার মোড়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ হয়।
সেখানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘মাথায় উত্তপ্ত রোদ, নিচে পিচঢালা পথ, মাঠে আওয়ামী লীগের অত্যাচার—সব রুখে দিয়েই এই সরকারের পতন ঘটাতে হবে। তিনি নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘সরকারের সময় শেষ হয়ে গেছে, এটা আপনাদের মনে রাখতে হবে। সে জন্য সরকার উল্টাপাল্টা আচরণ করছে। বিশ্ববাসী আজ এই সরকারের ওপর বিরক্ত, দেশবাসী এই সরকারের ওপর বিরক্ত, আমরাও এই সরকারের ওপর বিরক্ত। সুতরাং এই সরকার আর ক্ষমতায় থাকতে পারে না।’
মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালামের সভাপতিত্বে, ভারপ্রাপ্ত সদস্যসচিব তানভীর আহমেদের পরিচালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, রকিবুল ইসলাম, নাসিরউদ্দিন অসীম, কাজী আবুল বাশার, হাবিবুর রশীদ, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন প্রমুখ।