আওয়ামী লীগে সংঘাত-প্রাণহানি থামছে না, ৫ মাসে ২৮ খুন
গত বুধ ও বৃহস্পতিবার দুই দিনে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে তিনজন আওয়ামী লীগ নেতা খুন হন। তাঁরা হলেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে খুন হন জেলা পরিষদের সদস্য এবং নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় দিনে–দুপুরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় কাশিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক সুরজ মিয়াকে।
তিনটি খুনের ঘটনাই ঘটেছে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। এর মধ্যে বাঘায় খুনের ঘটনার পেছনে স্থানীয় দলিল লেখক সমিতি সরকারি ফির বাইরে বাড়তি যে চাঁদা আদায় করে, সেই চাঁদার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ইট–বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুনের ঘটনা ঘটে। এ দুটি খুনের ঘটনায় আক্রমণকারী ও নিহত দুই পক্ষই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে খুনের ঘটনার কারণ আধিপত্য বিস্তার। এর পেছনে রাজনৈতিক যুক্ততার বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় দিনে–দুপুরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় কাশিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক সুরজ মিয়াকে।
অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে খুনোখুনি থামছেই না। তৃণমূলের নেতা থেকে সংসদ সদস্য কেউ বাদ যাচ্ছেন না। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যসহ ২৮ নেতা খুন হয়েছেন। প্রায় সব ঘটনাতেই আক্রমণকারী ও ভুক্তভোগী দুই পক্ষই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ বিভেদ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে রাজনৈতিকভাবে এর সমাধানের কোনো পথ তাঁরা খুঁজে পাচ্ছেন না। হত্যাকাণ্ডের পর আইনি প্রক্রিয়ায় ঘাতকের বিচার করাই এখন লক্ষ্য। তবে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রভাবশালী কোনো না কোনো পক্ষের ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন। তাই সঠিক ও যথাসময়ে বিচার সম্পন্ন করাও কঠিন।
গত জাতীয় সংসদ ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নেয়নি। প্রতিটি ভোটেই আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ ছিল আওয়ামী লীগ। ফলে দলীয় কোন্দল আরও বেড়েছে। এর সঙ্গে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার এবং দখল, চাঁদাবাজি, চোরাকারবারির নিয়ন্ত্রণসহ নানা কারণে আগে থেকেই কোন্দল ছিল।
চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যসহ ২৮ নেতা খুন হয়েছেন। প্রায় সব ঘটনাতেই আক্রমণকারী ও ভুক্তভোগী দুই পক্ষই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী।
রাজশাহীর বাঘায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম নিহতের ঘটনায় রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা করার ঘোষণা দেন স্থানীয় সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম। মদদদাতা হিসেবে রাজশাহী-৩ (পবা-মোহন) আসনের সংসদ সদস্য মো. আসাদুজ্জামান, বাঘা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লায়েব উদ্দিনকেও আসামি করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
অবশ্য বৃহস্পতিবার বিকেলেই নিজের সম্পৃক্ততার কথা নাকচ করে দেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, মেয়র খায়রুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছিল যেন এই লাশটির দরকার ছিল একটি রাজনৈতিক পক্ষের। যেটাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক কোনো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়।’
দুই প্রভাবশালী নেতার পাল্টাপাল্টি অবস্থানে রাজশাহী আওয়ামী লীগও বিভক্ত হয়ে পড়েছে বলে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন।
গত ১৩ মে কলকাতায় ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তিনবারের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম ওরফে আনার খুন হন। এ ঘটনায় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম ওরফে মিন্টু এবং জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ ওরফে গ্যাস বাবু গ্রেপ্তার হয়েছেন।
তাঁরা জাতীয় সংসদ, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে সংঘাতে এবং অভ্যন্তরীণ বিভেদে নিহত হন। বাকি পাঁচজন বিএনপির নেতা-কর্মী। তাঁরা গত জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন।
রাজনৈতিক সংঘাত ও প্রাণহানি নিয়ে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, গত জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক সংঘাতে ৩৩ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে ২৭ জনই আওয়ামী লীগের। সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমসহ নিহত ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮। তাঁরা জাতীয় সংসদ, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে সংঘাতে এবং অভ্যন্তরীণ বিভেদে নিহত হন। বাকি পাঁচজন বিএনপির নেতা-কর্মী। তাঁরা গত জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, ২০১৮ সাল থেকে গত মে পর্যন্ত ছয় বছরে ২০২ জন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থক অভ্যন্তরীণ সংঘাতে মারা গেছেন।
অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও প্রাণহানির ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।
তিনি বলেন, বিভেদ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এমন নয়। দল বড়, বিপুল নেতা-কর্মী-সমর্থক রয়েছেন। এর মধ্যে কিছু আগাছা ঢুকে পড়েছে। তবে কেউ বিশৃঙ্খলা করলে সাংগঠনিকভাবে দল ও আইনিভাবে রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিচ্ছে।
দুই সংসদ সদস্য খুন
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ১৫ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংঘাত কমে গেছে। সামান্য যা হয়েছে, সেটা পুলিশ-বিএনপির মধ্যে। এখন রাজনৈতিক সংঘাত হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের মধ্যে, যা দলকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের দুজন সংসদ সদস্য খুন হয়েছেন। সর্বশেষ কলকাতায় খুন হন আনোয়ারুল আজীম। এর আগে ২০১৬ সালে গাইবান্ধায় নিজ বাসায় খুন হন মঞ্জুরুল ইসলাম। এ ঘটনায় ২০১৯ সালে জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল কাদের খানসহ সাত আসামির ফাঁসির রায় দেন আদালত।
আনোয়ারুল আজীম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় বিব্রত আওয়ামী লীগ। দলটির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, নিজ দলের সংসদ সদস্য হত্যায় দলেরই দায়িত্বশীল নেতাদের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠা লজ্জার। আর সংসদ সদস্য হত্যার পর তাঁর বিরুদ্ধে সোনা চোরাচালান, হত্যাসহ যেসব অভিযোগ উঠে এসেছে, তা-ও অস্বস্তির।
আলোচিত খুন
২০২২ সালের ২৪ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপুকে গাড়িতে থাকা অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা সামিয়া আফরান নামের এক কলেজছাত্রীও নিহত হন। এ ঘটনায় ৩৩ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। আসামিদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা।
২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি টাঙ্গাইল শহরের কলেজপাড়া এলাকায় নিজ বাড়ির কাছে জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সদস্য ফারুক আহমেদ খুন হন। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান ও তাঁর তিন ভাইয়ের নাম আসে।
আমানুর আত্মসমর্পণের পর তিন বছর কারাগারে ছিলেন। তিনি এখন জামিনে মুক্ত আছেন। গত জাতীয় নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৩ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। ২০১৮ সালে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে আমানুরের বাবা আতাউর রহমান খান সংসদ সদস্য হয়েছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হত্যার ঘটনায় আমানুরের ভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার তৎকালীন মেয়র সহিদুর রহমান খান কারাগারে আছেন। অপর দুই ভাই জাহিদুর রহমান খান ও ছানিয়াত রহমান খান পলাতক।
২০১৪ সালে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একরামুল হককে হত্যা করা হয় প্রকাশ্যে দিবালোকে। ফেনী শহরের একাডেমি এলাকায় গাড়িতে থাকা অবস্থায় একরামকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে, কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এ মামলায় ২০১৮ সালের ১৩ মার্চ ৩৯ আসামির বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দেন ফেনীর জেলা ও দায়রা জজ। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির, ফেনী পৌরসভার তৎকালীন কাউন্সিলর আবদুল্লাহ হিল মাহমুদ। অন্যরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী। আরও একজন ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর মামাতো ভাই আবিদুল ইসলাম।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, গত ১৫ বছরে সরকার বিপুল উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। সরকারি কেনাকাটায় কমিশন আদায় এবং হাট-ঘাট, পরিবহন খাতেও বিপুল চাঁদাবাজি করে অর্থ বানানোয় অনেকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে যেকোনো মূল্যে আধিপত্য ধরে রাখতে মরিয়া আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এ জন্যই সংঘাত ও প্রাণহানি ঠেকানো যাচ্ছে না।