এমপিদের আধিপত্যে বিভেদ বাড়ছে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে
সদ্য সমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের অনেকের এলাকায় নিয়ন্ত্রণ আরও পোক্ত হলো। নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের ৭০ শতাংশের বেশি মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজন কিংবা ঘনিষ্ঠ, যা নির্বাচনী এলাকায় মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের আধিপত্য বিস্তারে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকেরা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, অধিকাংশ সংসদীয় আসন একটি মাত্র উপজেলা নিয়ে গঠিত। মন্ত্রী-সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যান জোটবদ্ধ থাকলে তৃণমূলের অন্য নেতা-কর্মীরা গুরুত্ব পাবেন না। উন্নয়নমূলক কাজেও তাঁদের হস্তক্ষেপ বাড়বে। এমনিতে দলে বিভাজন-বিভক্তির কারণে সংঘাত লেগেই আছে। এখন ‘এমপি-বনাম তৃণমূল’ বিভেদ বাড়তে পারে। উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘাতে এবার সাতজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় এক হাজার। তাঁদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মী। নিজ দলের একে অপরকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে নেতা-কর্মীরা সংঘাতে জড়ান।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে নিষেধ সত্ত্বেও সন্তান-স্বজনদের ভোটে রাখেন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বজনদের জয়ী করতে ভূমিকা রেখেছেন সংসদ সদস্যরা। এটা দলের নেতৃত্বের প্রতি একধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার শামিল বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় কোনো কোনো নেতা।
চার ধাপে ৪৪২টি উপজেলায় ভোট শেষ হয় ৫ জুন। ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে স্থগিত হয়ে যাওয়া আরও ১৯টি উপজেলায় ভোট হয় ৯ জুন। সব মিলিয়ে ৪৬১টি উপজেলায় ভোট হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের মধ্যে ৩৩ জন বর্তমান মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজন। আরও তিন শতাধিক বিজয়ী চেয়ারম্যান স্থানীয় মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের পছন্দের। সব মিলিয়ে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজন ও ঘনিষ্ঠদের সংখ্যা ৩৫০, যা মোট উপজেলা চেয়ারম্যানের প্রায় ৭৭ শতাংশ। ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদেও একই চিত্র পাওয়া গেছে।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের চার মাসের মাথায় উপজেলায় স্বজন বা নিজেদের লোক বসিয়েছেন সংসদ সদস্যরা। দল চেষ্টা করেও তাঁদের নিবৃত্ত করতে পারেনি। আগামী দিনে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও জেলা পরিষদ নির্বাচনেও হয়তো এর ধারাবাহিকতা থাকবে। এতে তৃণমূলে ক্ষোভ আরও বাড়তে পারে।
চেয়ারম্যানদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন এমপিরা
গত ২২ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও বাস্তবে তা মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের জন্য সুবিধা এনে দেয়।
আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা প্রথম আলোকে বলেন, সংসদ সদস্যরা তাঁদের ভবিষ্যৎ প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন উপজেলা চেয়ারম্যানদের। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে ৫২ সংসদ সদস্য নির্বাচনে অংশ নেন। এর বড় অংশই স্বতন্ত্র হিসেবে ভোট করেন। এ জন্যই নিজের পছন্দের বাইরের কেউ যাতে চেয়ারম্যান হতে না পারেন, সেই চেষ্টা ছিল সংসদ সদস্যদের।
তবে পরিস্থিতিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এবার উপজেলা ভোটে কেউ প্রভাব খাটাতে পারেননি। ফলে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিরাই জয়ী হয়েছেন। আর জনপ্রিয় ব্যক্তিরা মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ হলে বরং দল আরও শক্তিশালী হবে।
স্বজনদের জিতিয়ে দলকে চ্যালেঞ্জ
মাদারীপুরে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ সদস্য শাজাহান খান আপন ভাইকে সরিয়ে ছেলেকে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করেন। জয়ী হন ছেলে আসিবুর রহমান খান। ভোটের পরই শাজাহান খান মাদারীপুর জেলা মোটর মালিক সমিতির সভাপতি করেছেন ছেলেকে। তিনি নিজে মাদারীপুর জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি এবং পরিবহনশ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনেরও সভাপতি।
শাজাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাবা রাজনীতিক ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি রাজনীতি করছেন এবং ছেলেও একই পথে এসেছেন।
নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী বর্ষীয়ান নেতা। দলের নেতৃত্ব তাঁকেই উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী প্রার্থী করেন ছেলে আতাহার ইশরাক সাবাব চৌধুরীকে। বহু চেষ্টা করেও সংসদ সদস্যের ছেলেকে বসাতে পারেনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। শেষ পর্যন্ত জয়ীও হন আতাহার ইশরাক।
নোয়াখালীতে আরও দুটি উপজেলায় সংসদ সদস্যরা সন্তানদের ভোটে দাঁড় করিয়ে জয়ী করেছেন। হাতিয়ায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর ছেলে আশিক আলী। সেনবাগে জয়ী হয়েছেন সংসদ সদস্য মোরশেদ আলমের ছেলে সাইফুল আলম।
আলোচিত মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের মধ্যে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে কৃষিমন্ত্রী আবদুস শহীদের ভাই ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথমবারের মতো উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছেন। নরসিংদীর মনোহরদীতে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের ছোট ভাই নজরুল মজিদ মাহমুদ এখন চেয়ারম্যান। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার জামাতা বিশ্ব প্রতীপ কারবারী খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার চেয়ারম্যান হয়েছেন।
বগুড়া-১ সংসদীয় আসনটি সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলা নিয়ে গঠিত। এবার সারিয়াকান্দি উপজেলার চেয়ারম্যান হয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছেলে সাখাওয়াত হোসেন। আর সোনাতলায় চেয়ারম্যান সংসদ সদস্যের ভাই মিনহাদুজ্জামান।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, তৃণমূলে বিভেদ সৃষ্টি করে কেউ পার পাবে না। একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার ও বিভেদ করা হলে কেন্দ্র থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।