সাবেক সেনাপ্রধান আজিজের ভাইয়ের ভুয়া পরিচয় তৈরিতে তিন সেনা কর্মকর্তার ‘সুপারিশ’ নিয়েও প্রশ্ন
মিথ্যা তথ্য দিয়ে মোহাম্মদ হাসান নামে নতুন পরিচয় ধারণ করেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের ভাই হারিছ আহমেদ। জমির দলিলসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন কাগজপত্রের জন্য ভুয়া পরিচয় তৈরিতে তিনজন সেনা কর্মকর্তার ‘সুপারিশ’ ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে।
এর মধ্যে দুজন সেনা কর্মকর্তার একজন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, তাঁরা এ ধরনের কোনো সুপারিশ করেননি। আরেকজন দাবি করেছেন, একটি দলিলে থাকা সই তাঁর সইয়ের কাছাকাছি। কিন্তু এটি তাঁর সই নয়। ফলে সাবেক সেনাপ্রধানের ভাইয়ের ভুয়া পরিচয় তৈরিতে সেনা কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করে ভুয়া সুপারিশ করা হয়েছিল কি না, সে প্রশ্নও সামনে এসেছে।
দেশের একাধিক থানা ও আদালতের নথিপত্র, সাজা মওকুফ চেয়ে (আজিজের আরেক ভাই তোফায়েল আহমেদ জোসেফের জন্য) মায়ের করা আবেদনসহ সাজা মওকুফের সরকারি প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, হারিছের বাবার নাম রয়েছে আব্দুল ওয়াদুদ ও মায়ের নাম রেনুজা বেগম। কিন্তু হারিছ যে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নিয়েছেন, তাতে বাবার নাম সুলেমান সরকার এবং মায়ের নাম রাহেলা বেগম উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট তিনি এনআইডিতে নিজের ছবি পরিবর্তন করেন। ভুয়া এনআইডিতে ভাইয়ের ছবি পরিবর্তনে সুপারিশ করেন তখনকার সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোহাম্মদ হাসান পরিচয়ে ভোটার হওয়ার জন্য ২০১৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নিবন্ধন ফরম পূরণ করেছিলেন হারিছ। তাঁর ওই আবেদনের ওপর রেফারেন্স হিসেবে লেখা আছে ‘ব্রি. জে. আখতারুজ্জামান, ডিজি সিগন্যাল, ১৬/০২/১৪’। আবেদনের দুদিনের মাথায় মোহাম্মদ হাসান নামে হারিছ আহমেদের জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যু করা হয়। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট তিনি এনআইডিতে নিজের ছবি পরিবর্তন করেন। ভুয়া এনআইডিতে ভাইয়ের ছবি পরিবর্তনে সুপারিশ করেন তখনকার সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ।
জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার কাজটি করে থাকে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কেউ ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হলে তাঁকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভোটার নিবন্ধন বা কোনো তথ্য সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী কারও লিখিত বা মৌখিক সুপারিশ থাকলে ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সুপারিশকারীর নাম আবেদনের সঙ্গে ‘রেফারেন্স’ হিসেবে লিখে রাখেন। ওই আবেদনপত্রটি সংরক্ষণ করা হয়। এভাবে সুপারিশকারীর নাম লিখে রাখা হয় মূলত পরবর্তী সময়ে কোনো সমস্যা হলে যাতে সহজে বের করা যায়, কার সুপারিশ ছিল।
হারিছ যে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নিয়েছেন, তাতে বাবার নাম সুলেমান সরকার এবং মায়ের নাম রাহেলা বেগম উল্লেখ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যাঁর নাম ভোটার নিবন্ধন ফরমে রেফারেন্স হিসেবে লেখা আছে, তিনি অবসরে যাওয়া ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আখতারুজ্জামান সিদ্দিকী। তিনি ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের ‘আইডেনটিফিকেশন সিস্টেম ফর অ্যাকসেস টু সার্ভিসেস’ (আইডিইএ) প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন। এই প্রকল্পের অধীনেই জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া শুরু করেছিল ইসি। তিনি জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালকেরও দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০১৩ সালের মার্চ থেকে ২০১৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি সেনা সদরদপ্তরে পরিচালক (সিগন্যালস) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের ডিন এবং সর্বশেষ ট্রাস্ট ব্যাংকের আইটি উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
মিথ্যা পরিচয়ে সাবেক সেনাপ্রধানের ভাইয়ের ভোটার নিবন্ধন ফরমে রেফারেন্স হিসেবে নাম থাকার বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় আখতারুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ সালে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগে ছিলেন না। তখন তিনি সিগন্যালসে ছিলেন। তিনি কোথাও কাউকে এ রকম সুপারিশ করেননি বলে দাবি করেন। তাহলে তাঁর নাম এল কীভাবে—এমন প্রশ্নের জবাবে আখতারুজ্জামান বলেন, এটা যাঁরা লিখেছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করতে হবে।
সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের দুই ভাই হারিছ আহমেদ ও তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ নিজের ও বাবা-মায়ের নাম বদলে এনআইডি করেন। এর মধ্যে জোফেস দুটি এনআইডি নেন, যা আইনত দণ্ডনীয়।
২০২১ সালে আল-জাজিরায় প্রচারিত একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে, মোহাম্মদ হাসান নামে হারিছ একটি দলিল করেছিলেন ২০১৪ সালে। যেটি সত্যায়ন করেছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে সাক্ষী হিসেবে নাম আছে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কে বাশারের। তাঁর ঠিকানা লেখা আছে, বিজিবি, পিলখানা। মেজর মো. সুজাউল হক নামে আরেকজনের নাম আছে সাক্ষী হিসেবে। তাঁরও ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে বিজিবি, পিলখানা। ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক ছিলেন আজিজ আহমেদ।
বিজিবির সদর দপ্তরে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড ট্রেনিং) হিসেবে কর্মরত ছিলেন, এখন লিবিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল আবুল হাসনাত মোহাম্মদ খায়রুল বাশার। গত শুক্রবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এ রকম একটি তথ্যচিত্র আল-জাজিরায় প্রচারিত প্রতিবেদনে দেখেছেন। তাতে নাম লেখা হয়েছে ‘আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কে বাশের (Basher)’। তিনি কখনো এভাবে তাঁর নাম লেখেন না। তিনি সব সময় ‘আবুল হাসনাত মোহাম্মদ খায়রুল বাশার (Bashar)’ লেখেন। সইটি তাঁর সইয়ের কাছাকাছি হলেও এটি তাঁর সইয়ের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। আর তিনি এ ধরনের কোনো নথিতে সই করেছেন বা কেউ তাঁকে এ রকম সই করতে বলেছেন বলে তাঁর মনে পড়ে না। অন্য কাউকে দিয়ে এটি করানো হয়েছি কি না, তা তিনি জানেন না।
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন অনুযায়ী, জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা জ্ঞাতসারে কোনো মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য দেওয়া অথবা তথ্য গোপন করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ অপরাধের শাস্তি অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড। কোনো ব্যক্তি জাতীয় পরিচয়পত্র জাল করলে বা জ্ঞাতসারে ওই জাতীয় পরিচয়পত্র বহন করলে তিনি সাত বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কোনো ব্যক্তি পরিচয়পত্র জাল করার কাজে সহায়তা করলে তাঁরও সাজা সাত বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড।
সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের দুই ভাই হারিছ আহমেদ ও তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ নিজের ও বাবা-মায়ের নাম বদলে এনআইডি করেন। এর মধ্যে জোফেস দুটি এনআইডি নেন, যা আইনত দণ্ডনীয়।
সেনাপ্রধান থাকার সময়েই আজিজ আহমেদের ভাইদের ভুয়া তথ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করানোর ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাব খাটানোর বিষয়ে প্রথম আলোসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। তবে এসব বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আজিজ আহমেদের ভাই হারিছ দুটি এবং আরেক ভাই আনিস একটি খুনের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ তাঁদের সাজা মওকুফের প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
১৯৯৬ সালে মোহাম্মদপুরের ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান হত্যা মামলার আসামি ছিলেন জোসেফ। এ মামলায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। এই রায় বহাল রাখেন হাইকোর্ট। পরে আপিল বিভাগ সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। ২০১৮ সালে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পান।
আজিজ আহমেদ ২০১৮ সালের ২৫ জুন থেকে ২০২১ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সম্প্রতি এই সাবেক সেনাপ্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে অযোগ্য হয়েছেন।